নিজস্ব প্রতিবেদক:
ধনেও নয়, জনেও নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যে প্রকৃতির অপরূপ এক নাম দেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাংগুয়ার হাওর। সংস্কৃতির তীর্থ স্থান কিংবা মৎস্য, পাথর ধানের সম্পদ হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার প্রকৃতির এই অপরূপ লীলাভূমিতে টাংগুয়ার হাওরের অবস্থান। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বঞ্চনার গ্লানি টানলেও অনেক ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ বিলিয়ে দিয়েছে তার রূপরহস্য। প্রাকৃতিক সম্পদও যেন হাওরঘেরা জনপদ সুনামগঞ্জকে দেশ কিংবা দেশের সীমার বাইরেও আলাদাভাবে পরিচয় করে দিয়েছে। মরমী কবি হাছন রাজা ও বাউল সাধক শাহ আবদুল করিমের এই জেলায় রয়েছে স্বচ্ছ জল আর ছায়াবৃক্ষ হিজল করচের হাওর ‘টাংগুয়ার’।
তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর এলাকা নিয়ে টাংগুয়ার হাওর। হাওর এলাকায় রয়েছে ছোটবড় ৫২টি বিল ও ৮৮টি গ্রাম। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের কোলঘেঁষা টাংগুয়ার হাওর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। প্রকৃতির অবিশ্বাস্য দান রয়েছে যেখানে। ত্রি-মিতালীর দেখা মেলে এই ‘টাংগুয়ার’ হাওরে।
কালে আবর্তে এই প্রকৃতি কন্যা টাংগুয়ার হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য হারিয়েছে। গত এক দশকে এ হাওরের গাছ-গাছালী, জলজ বন, মাছ ও জলজ প্রাণী কমেছে অন্তত ৯০ ভাগ।
তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের গোপিনাথ নোয়াগাঁও গ্রাম ও টাংগুয়ার হাওরের দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দা কেজি মানব তালুকদার জানান, প্রায় এক যুগ আগেও টাংগুয়ার হাওরের ছিল হিজল ও করচের বাগ, নানা জাত ও রঙের পাখির কলতান। হাওরে ছিল নল ও খাগড়া। ছিল জলজ উদ্ভিদ কাটা শলাবন, চাইল্লাবন। (যা দিয়ে জেলার তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ ও মধ্যনগর থানার অধিবাসীরা) বর্ষা মৌসুমে ঢেউয়ের আফাল থেকে বাড়ি রক্ষা করতে টাংগুয়ার হাওর থেকে এগুলো নিয়ে যেতেন। ছিল প্রচুর মাছ, বউল্লা, বন তুলসী। ‘এখন এ হাওরটিতে শুধু পানি আর পানি ছাড়া কিছুই নেই’ আক্ষেপ করে বলেন তিনি।
তাহিপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম পরিবর্তন ডটকমকে জানান, টাংগুয়ার হাওরে আগে অনেক পাখি আসত। তখন পাখি আকাশে উড়লে সূর্য দেখা যেত না। হাওরে নৌকা বেয়ে গেলে বড় বড় রুই মাছ লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে যেতে।
এখন জাল ফেলে একটি রুই মাছ ধরা পড়ে না। এর একমাত্র কারণ ব্যবস্থাপনার নামে এ হাওরের অব্যবস্থাপনা চলছে। এ যেমন নল খাগড়া নেই তেমনি নেই জলজ উদ্ভিদ। দিন দিন কমে যাচ্ছ পাখি ও মাছের খাবার। ‘টাংগুয়ার হাওরে প্রতিদিন রাতে অপরিকল্পিতভাবে হাওরে নামে হাজার হাজার জেলে। মাছের ডিম পর্যন্ত ধরে নিয়ে যায়।’ বলেন আওয়ামী লীগের এ নেতা।
হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা জানান, যেভাবে টাংগুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। তাকে রক্ষা করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এ হাওর এলাকার হাজার হাজার মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পাশাপাশি টাংগুয়ার হাওরবেষ্টিত গ্রামের লোকজনকে সচেতন করে তুলতে হবে।
এদিকে গত ১৮ জুলাই সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে টাংগুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনা কমিটির ৪৮তম সভায় উপস্থিত সদস্যদের তোপের মুখে পড়েন ইন্টারন্যশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার(আইইউসিএন)’র টাংগুয়ার হাওর প্রকল্পের ব্যবস্থপক ওয়াহিদুজ্জামান সরকার।
জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সুনামগঞ্জ-২৮ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল নাসির উদ্দিন আহমেদ, সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ প্রমুখ।
সভায় সিভিল সার্জন ডা. আশুতোষ দাশ বলেন, আইইউসিএন টাংগুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনায় নেওয়ার আগে এ হাওরে প্রচুর গাছ-গাছালী ও পাখি ছিল এবং হাওরে নৌকা বেয়ে গেলে বড় বড় মাছ নৌকায় লাফ দিয়ে উঠত। ২০০৬ সাল থেকে আইইউসিএন হাওরটির দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন আর সেই অবস্থা নেই।
বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল নাসির উদ্দিন আহমেদ জানান, তিনি ২০০৩ সালে অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় টাংগুয়ার হাওরে এসেছিলেন। সে সময় তিনি প্রচুর পাখি ও মাছ এবং মনকাড়া পরিবেশ দেখেছেন। এখন তিনি টাংগুয়ার হাওরের সেসব জায়গা আর চিনতে পারেননি। হাওরটি এখন নিস্তব্দ হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে আইইউসিএন’র টাংগুয়ার হাওর প্রকল্পের ব্যবস্থপক ওয়াহিদুজ্জামান জানান, আইইউসিএন টাংগুয়ার হাওরের মূল ব্যবস্থাপনায় ছিল না। সংস্থাটি টেকনিক্যাল সার্পোট দিয়েছে মাত্র। তিনি আরো জানান, আইইউসিএন এবার এসেছে টাংগুয়ার হাওরের গ্রামগুলোর মানুষকে সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি করে এ হাওরটিকে একটি নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তোলা। ওয়াহিদুজ্জামান জানান, টাংগুয়ার হাওরে মাছ ধরার জন্য নিবন্ধিত প্রায় ৩ হাজার জেলে রয়েছে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ