বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছি। আমরা আগামী নির্বাচনে অংশ নেব না এ কথা একবারও বলিনি।’ তিনি বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সব মেশিনারিজ থাকে সরকারের হাতে। এজন্য আমরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি।’
সোমবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্টের একটি টক শোতে অংশ নিযে ফখরুল এসব কথা বলেন। খালেদ মহিউদ্দিনের সঞ্চালনায় ‘আজকের বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে একমাত্র অতিথি ছিলেন ফখরুল।
আগে থেকেই শর্ত দিলে কী বিষয়ে সংলাপ হবে?-এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘আমরা শর্ত ছাড়া সংলাপের কথা বলেছি সবসময়। সংলাপ তো শুরু হলে বিষয়গুলো সামনে আসবে।’
প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসন আলোচনায় রাজি হননি- এই প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ফোন করছিলেন সত্য, কিন্তু একটা কথা প্রধানমন্ত্রী এড়িয়ে যান। আমাদের নেত্রী বলেছিলেন একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছে। এটি শেষ হলে পরদিন আমি আসবো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা শুনেননি।’
কিন্তু পরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন করা যেত কি না। আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপির কোনো উদ্যোগ ছিল না?-এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘কথাটা ভুল। কারণ আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে আমি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাহেবকে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনি জবাবও দিয়েছিলেন। তাহলে আমরা উদ্যোগ নিইনি কীভাবে?’
ফখরুল বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশের রাজনীতিতে এই ধরনের চিঠি চালাচালি সাধারণ সম্পাদক লেভেলে হয়। কিন্তু তাকে (প্রধানমন্ত্রী) ফোন করা হয়নি বলে সারা জাতি সাফার করবে? একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হবে? এটা তো হতে পারে না।’
৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, ‘এই মামলাটির কোনো ভিত্তি নেই। এই মামলাটি নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে দ্রুততার সঙ্গে রায় দেয়া হচ্ছে।’ এ সময় ফখরুল প্রশ্ন রাখেন, এরশাদ সাহেবের দুর্নীতির মামলা কতদিন ধরে চলছে, এর জবাব দেন।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি বড় দল। যদি গণতান্ত্রিক চর্চা করতে চান তাহলে বাধা কোথায়?-এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘আমাদেরকে রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। আমরা জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা করতে চেয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন স্থানে আমরা এই সভা করতে চেয়েছি। কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমরা বসুন্ধরা কনভেশন হল বুকিং দিয়েছিলাম। টাকাও জমা দিয়েছি। কিন্তু আজ (সোমবার) দুপুরে জানিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানেও দেয়া সম্ভব নয়।’
ফখরুল বলেন, ‘তাদের ইচ্ছামত দেবে আর আমরা সেইভাবে সমাবেশ করতে হবে এটা কোনো রাজনীতি না। এটা হলো প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করা।’
খালেদা জিয়ার মামলার রায় আপনি বলেছেন যেনতেন রায় হলে জনগণ তা মেনে নেবে না-এই বক্তব্য আদালত অবমাননা কি না?-এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রাজনৈতিক কথা বলি। সেটা কোনোভাবে আদালত অবমাননা নয়।’ এ সময় তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এদেশে কোনটা আদালত অবমাননা কোনটা অবমাননা না এটা বোঝা মুশকিল।’ এ সময় তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিলের বিভাগের রায়ের পর প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার বিরূপ মন্তব্যের কথা তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়ার রায়ের পর বিএনপি কী করবে এ প্রসঙ্গে মহাসচিব বলেন, ‘এখন বলবো না। রায় এখনো দেয়া হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন, এই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায় দেয়ার সুযোগ নেই।’
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এই মামলার কোনো ভিত্তি নেই দাবি করে ফখরুল বলেন, ‘এই ট্রাস্টের সঙ্গে খালেদা জিয়া কোনোভাবেই জড়িত নন। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা কোনো দুর্নীতি পাননি। পরে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা দিয়ে অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে।’
এ সময় ফখরুল জানান, ট্রাস্টের কোনো টাকা খরচ হয়নি। তখন যে টাকা এসেছে তা এখন তিন গুণ হয়েছে এবং ব্যাংকে জমা আছে। এছাড়া দুদক এই মামলা করতে পারে কি না এটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপির নির্বাচনকালীন রূপরেখা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা- এটার কথা আমরাই প্রথম বলেছি। নির্বাচনকালে এই সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তৈরি করছি। চেষ্টা করছি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমনভাবে পেশ করতে। তবে প্রস্তাবটি এখনই দিচ্ছি না। রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে মনে করছি এখন রূপরেখা দেয়ার সময় হয়নি।’
বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক ডাকা প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, ‘এটা বৈঠক না, ডিপ্লোমেটিক ব্রিফিং। এটা প্রচলিত ব্যাপার। সামনে নির্বাচন, বেগম খালেদা জিয়ার মামলার বিষয় থাকবে সেই ব্রিফিংয়ে।’
ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কেমন-এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘প্রত্যেকটি দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এটাও মনে করি কোনো রাষ্ট্র আমাদের প্রভু না। সে হিসেবে ভারতের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক ভালো।’
জাতীয় নির্বাচনে কোনো ভূমিকা বা প্রভাব ভারত রাখে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোনো রাষ্ট্রের জন্যই তা উচিত না। প্রভাব রাখে কি না এই বিষয়টি আমার বলার কথা না। কারণ যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বলতে পারবে। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। অনেক দাবি আমরা আদায় করেছি।’
আওয়ামী লীগ বলে থাকে ২০১৫ সালে কর্মসূচিতে পেট্রলবোমা মেরে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনারা কি মনে করেন সেই সময়ের কর্মসূচি ভুল ছিল? সেটা নিয়ে আপনারা অনুতপ্ত কি না, আবারো সেই ধরনের কর্মসূচির দিকে যাচ্ছেন কি না?
ফখরুল বলেন, ‘কথাগুলো কিন্তু তদন্তপূর্বক খবর না। ওই সময় অনেক খবর এমনও পাওয়া গেছে ঘটনাগুলো সরকারই ঘটিয়েছে। বিএনপি এটা করেছে আমি এটা মনে করি না। বিএনপি একটা রাজনৈতিক দল। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন না। আমরা কখনোই সহিংসতা পছন্দ করি না।’
এ সময় তিনি সেই সময়কার ঘটনাগুলো নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান। প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও বলেন ফখরুল।
বিএনপি নেতাকর্মীদের সরকার নির্যাতন করছে এমন অভিযোগ করে ফখরুল একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেন। বলেন, ‘সারাদেশে আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৭৮ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় ১৮ লাখের মতো আসামি। আমার বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা রয়েছে।’
এ সময় ফখরুল তার নিজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর কোনো ভিত্তি নেই দাবি করে বলেন, ‘অজ্ঞাত দুজন লোক মোটরসাইকেলে করে এসে সচিবালয়ে বোমা মেরে চলে গেছে। এই বোমা হামলার নির্দেশদাতা নাকি আমি। আমি নাকি ময়লার গাড়িতে আগুন দিয়েছি, আমি নাকি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছি।’
বিএনপিতে ব্যবসায়ীরা মনোনয়ন পায় এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফখরুল বলেন, ‘এটা শুধু বিএনপির ক্ষেত্রে কেন বলছেন? অন্য রাজনৈতিক দলের কথা কেন বলেন না। অনেক সময় কিছু বিষয় থাকে, ক্ষমতায় যাওয়ার একটা টার্গেট থাকে। তবে যে ভালো কাজ করে আমরা তাকেই মনোনয়ন দিই। শুধু টাকাওয়ালাকে মনোনয়ন দেয়া হয় এটা ঠিক না।’
এ সময় ফখরুল নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘কই আমার তো টাকা নেই। এটা সবাই জানে। আমি তো মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করে দলের মহাসচিব হয়েছি। আমার মতো বহু লোক দলে আছেন। ব্যবসায়ী যদি কেউ জনপ্রিয় থাকেন তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। ব্যবসায়ী হওয়া তো দোষের কিছু না।’
সঞ্চালক সবশেষে ফখরুলের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য জানতে চান। তখন তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা। আসুন আমরা সেটা বাস্তবায়ন করি।’
ফখরুল বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই সংগ্রাম করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। তাকে মিথ্যা মামলায় হেনস্থা করা হচ্ছে, এটা আমরা কেউ ভালোভাবে দেখছি না। তারপরও আমরা আশা করি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। দেশে শান্তি ফিরে আসবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’