২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:৫০

মাহে রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি

আর কয়েক দিন পরেই মাহে রমজানের বাঁকা চাঁদ পশ্চিমাকাশে উদিত হবে; রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে আমাদের মধ্যে হাজির হবে মাহে রমজান। পবিত্র এ মাসকে বরণ করে নিতে চলছে বিভিন্ন প্রস্তুতি। রমজান শব্দটি এসেছে ‘রমজ’ থেকে-এর অর্থ ভস্মীভূত করা। কী হবে ভস্মীভূত? সঠিকভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমাদের পাশবিকতা ভস্মীভূত হবে, আর আমরা হয়ে উঠব মানবতার কল্যাণে নিবেদিত পূর্ণ মানুষ। এটাই রোজার মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে সফল ব্যক্তিদের জন্য বেহেশতে ‘রাইয়ান’ নামে একটি দরজা সদা উন্মুক্ত থাকবে। হাদিসে কুদসিতে এসেছে আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য, আর আমি নিজেই এর পুরস্কার দেবো। বাস্তবে সব ইবাদত মানুষ দেখতে পায়। একমাত্র রোজাই মানুষ দেখতে পায় না। রোজাদারের মতো থেকেও একজন মানুষ যদি গোপনে কিছু খায় তা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। এটা একমাত্র জানবেন আল্লাহ। আর এ জন্যই এ রোজার প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা নিজেই দেবেন। সারা জাহানের প্রতিপালক, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর নিজের দেয়া পুরস্কার কত মূল্যবান হবে তা আমাদের কল্পনার রাজ্যেও রূপ দেয়া অসম্ভব। এ মহা সৌভাগ্য বহনকারী মাহে রমজান আমাদের দ্বারে সমাগত। এ মাহে রমজানকে কি আমরা স্বাগত না জানিয়ে পারি? শুভেচ্ছা-স্বাগতম জানিয়ে একটি মিছিল, কিছু পোস্টারিং,পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা ছাপানো, রেডিও ও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার- কেবল এগুলোই কি রমজানকে বরণ করে নেয়ার জন্য যথেষ্ট? না। রমজানকে সঠিকভাবে বরণ করে নিতে হলে প্রত্যেক মুমিনের থাকতে হবে বিশেষ প্রস্তুতি, বিশেষ পরিকল্পনা। প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়া বড় ধরনের কিছু অর্জন করা যায় না। মহানবী সা: রমজানের আগেই রমজানের প্রস্তুতি নিতেন। রজব মাস ( শাবান মাসের আগের মাস) এলেই তিনি দোয়া করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা ইলা রমাদান’ (হে আল্লাহ আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমজানে পৌঁছে দিন)। শাবান মাস (রমজান মাসের আগের মাস) থেকে তিনি আরো অধিক ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন যাতে করে মহামূল্যবান রমজান থেকে সর্বোচ্চ ফায়দা নিতে পারেন। তাই আমাদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে, নিতে হবে বিশেষ পরিকল্পনা।

রমজানের আগেই যা করণীয়
এক. বিশেষ কোনো সফর বা বড় ধরনের কোনো কাজ থাকলে রমজানের আগেই বাড়তি শ্রম দিয়ে তা সেরে ফেলুন।
দুই. রোজার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা রোজার আগেই শেষ করুন। তিন. রমজানটা আপনি কিভাবে কাটাবেন তার জন্য দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ হোন। সম্ভব হলে আপনার পরিকল্পনাটা লিখে ফেলুন। এ লিখিত পরিকল্পনা আপনাকে দ্বীনের পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করবে। এ ক্ষেত্রে আপনি আপনার পরিকল্পনায় নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো রাখতে পারেন-
(ক) পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত : মাহে রমজানে আপনি কতটুকু তেলাওয়াত করতে চান তা আপনার শক্তি, সামর্থ্য ও সময় বিবেচনা করে লিখুন।
(খ) কুরআন অধ্যয়ন : পবিত্র রমজানে কুরআন নাজিল হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য। তাই অর্থ ব্যাখ্যাসহ কুরআন বোঝা একান্ত জরুরি। এ মাসে অবশ্যই একটা উল্লেখযোগ্য সময় আল্লাহর কালাম বোঝার জন্য বরাদ্দ করুন।
(গ) সহিহ তেলাওয়াত শিক্ষা : সহিহ তেলাওয়াত বিশুদ্ধ নামাজের শর্ত। এ পবিত্র রমজানে আপনি মহল্লার মসজিদে রমজান উপলক্ষে আয়োজিত কুরআন প্রশিক্ষণ ক্লাসে সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে শামিল হোন। অথবা একজন ভালো কারীর কাছে ব্যক্তিগতভাবে বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের প্রশিক্ষণ নিন। নিবিড় প্রচেষ্টা চালালে এক মাসেই আপনি বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শিক্ষায় একটা ন্যূনতম মানে চলে আসতে পারবেন। যারা জানেন তারাও এ মহৎ কর্মে অংশ নিলে তা আপনাদের তেলাওয়াতের মানকে আরো সুন্দর করবে।
(ঘ) তাফসির, হাদিস, ইসলামি সাহিত্য ক্রয় : এ মাসে বিভিন্ন ইসলামি প্রকাশনা তাদের সাহিত্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ কমিশন দেয়। আপনি সুযোগটি গ্রহণ করুন। পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ তাফসির, সিহাহ সিত্তার হাদিস সমগ্র ও ইসলামি আদর্শের মৌলিক গ্রন্থাবলি কেনার জন্য আপনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করুন এবং সম্ভব হলে রমজানের আগেই তা কিনে ফেলুন। এ বইগুলো আপনার জ্ঞানকে করবে সমৃদ্ধ, চরিত্রকে করবে মার্জিত। একই সাথে এ বইগুলো আপনার ব্যক্তিগত পাঠাগারে শ্রীবৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবার পরিজনের মধ্যে দ্বীনের সৌরভ ছড়িয়ে দিয়ে আপনার জন্য সাদকায়ে জারিয়ার ব্যবস্থা করবে। তাই আর বিলম্ব নয়, রমজানের আগেই পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করুন।
(ঙ) নফল ইবাদাত : তারাবিহ, নফল ইবাদত ও দান সদকার ব্যাপারেও আপনি পরিকল্পানা নিতে পারেন। এ পরিকল্পনা আপনাকে অলসতা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। আপনি জাকাতের দাতা হলে জাকাত হিসাব-নিকাশ ও বিলিবণ্টনের কাজটি এ মাসে সেরে নিতে পারেন। এ মাসের একটি বিশেষ ফজিলত হলো এ মাসে একটি ফরজ ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান এবং একটি নফল একটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব। তাই মহান আল্লাহর এ স্পেশাল অফার গ্রহণে আমাদের উৎসাহী হওয়া একান্ত জরুরি। সেহরির কারণে এ মাসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা খুবই সহজ। কিন্তু অনেকেই এ সময়ে রেডিও-টিভির সেহেরি অনুষ্ঠান শোনা ও দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতে ইসলামি জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে, সওয়াবও হবে কিন্তু হাদিস অনুযায়ী আপনি বেশি লাভবান হবেন যদি এ সময়টা আপনি নামাজ, কুরআন তেলাওয়াত, জিকির, দোয়া-দরুদ পাঠ ও আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করে কাটান।
(চ) ইতিকাফ : রমজানে ইতিকাফ করতে চাইলে আপনাকে তারও দৃঢ় পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে নেক ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পারিবারিক কাজগুলোও আপনাকে আগেই শেষ করতে হবে।
(ছ) পারিবারিক সংশোধন : রমজানে আপনি পারিবারিক সংশোধনের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিতে পারেন। এ জন্য আপনি দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় তালিমের জন্য বেছে নিন। এ ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের মতামত নিলে সবার পক্ষ থেকে সাড়া পাবেন। কারণ পবিত্র রমজানে মানুষের মধ্যে দ্বীনের কথা শোনার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
(জ) রমজানের পবিত্রতা রক্ষা : রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় বিশেষ পরিকল্পনা নিন। কোনো বদ অভ্যাস থাকলে তা ছাড়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ যাতে বেরোজাদার না থাকে তার জন্য রমজানের আগেই তাদের সতর্ক করুন। আপনার পয়সায় আপনার ঘরে দিনের বেলায় পবিত্র রমজানে শিশু ও অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ছাড়া অন্যের অন্ন সংস্থানের সব পথ বন্ধ করে দিন। এ ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিত্ব, কঠোরতা ও দরদভরা উপদেশ সবাইকে রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে। এ ব্যাপারে রমজানের আগেই যাথার্থ পরিবেশ তৈরি করুন। মনে রাখবেন বকাঝকা ও রাগারাগি আপনার মহৎ ইচ্ছাকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। সমাজে আপনার দায়িত্বের পরিধি যত বেশি, রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় আপনার কর্তব্যও তত বেশি। রমজানের আগে গৃহীত পরিকল্পনা প্রতিদিন সম্ভব না হলেও অন্তত সপ্তাহে এক দিন আপনি পর্যালোচনা করুন।
কোথাও গাফলতি থাকলে তা দূর করুন। আপনার নেক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমাদের ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা একান্ত জরুরি। খালেসভাবে আল্লাহর পথে আগাতে চাইলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। তাই আসুন, রমজানের আগেই রমজানকে বরণ করে নেয়ার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নিই।

#অধ্যাপক মিজানুর রহমান

প্রকাশ :মে ১২, ২০১৭ ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ