২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ওইদিন বেলা দেড়টায় জাতীয় সংসদে এ বাজেট পেশ করেন। মোট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার এ মেগা বাজেটে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেটের এক চতুর্থাংশেরও বেশি অংশ ঘাটতি হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঘাটতির এ অর্থ অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে পূরণ করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেটে ফাস্টফুড আইটেম, মশলা জাতীয়পণ,্য টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিকপণ্য, সিমকার্ড, জুতা ইত্যাদির শুল্ক বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে জীবন্ত ঘোড়া, গাধা খচ্চর, ঘোটক, জীবন্ত গবাদিপশু, গবাদিপশুর মাংসের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম কমবে বলে বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার মধ্যে উন্নয়নখাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আর অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতনভাতা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
বাজেট ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং অর্থনীতিবিদগণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সঙ্গত কারণেই প্রস্তাবিত বাজেটকে গণমুখী ও উন্নয়নমূলক বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করে স্বাগত জানিয়েছে। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে একটি যুগোপযোগী উন্নয়নমূলক বাজেট দেয়া হয়েছে। অপরদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ বাজেট জনকল্যাণে নয়, রাজনৈতিক স্বার্থে দেয়া হয়েছে। এ বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে- এ বাজেট গরীব মারার সর্বশ্রেষ্ঠ বাজেট। বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণও। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন যোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ঘোষিত বাজেটে শুধু গাণিতিক হিসাবই প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি আগামী অর্থ বছরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশাবাদ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশংকা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন প্রস্তাবিত বাজেটকে শিল্প ও ব্যবসা অনুকূল বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, আমরা মনে করি বাজেটে যে বড় বড় প্রকল্পগুলো নেয়া হয়েছে, সেগুলো যদি স্বল্প সময়ে বাস্তবায়ন করা যায় তাহলে এটি অবশ্যই ভালো বাজেট।
বাজেট ঘোষণার পরদিন গত শুক্রবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনে পুরো বাজেটই উজ্জ্বল বলে মন্তব্য করে বলেছেন, ঘোষিত বাজেটে কোথাও কোনো দুর্বলতা নেই। এ বাজেট তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট বলেও উল্লেখ করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রস্তাবিত ভ্যাট আইন অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার বাস্তবায়ন হলেও দ্রব্যমূল্য বাড়বে না।
বাজেট সম্পর্কে উল্লিখিত মন্তব্যসমূহকে গতানুগতিকই ধরে নেয়া যায়। যত ভাল বাজেটই দেয়া হোক বিরোধী দল তার সমালোচনা করবে আর গণবিরোধী বাজেট হলেও সরকারি দল তাকে চমৎকার বলে অভিহিত করবে। তবে এবারের বাজেট নিয়ে অর্থনীতিবিদগণের মন্তব্য লক্ষণীয়। তারা প্রায় সবাই বাজেটের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না। উন্নয়ন এবং রাজস্ব ব্যায়ের যে উৎস সমূহের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কতোটা প্রবহমান থাকবে তা নিয়ে সংশয় থাকাটা অসমীচীন নয়। কেননা, ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস তথা ব্যাংক সমূহ থেকে ঋণ নেয়ার যে কথা বলা হয়েছে তাতে দেশের শিল্পায়ন ও বাণিজ্য খাতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার যদি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ হিসেবে নিয়ে নেয়, তাহলে বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহে যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য।
ঘোষিত বাজেটের একটি মারাত্মক নেতিবাচক দিক হলো ব্যাংক আমানতের ওপর অবগারী কর ধার্য করা। বলা হয়েছে- কোনো ব্যক্তির বছরের যে কোনো সময় ব্যাংকে স্থিতি এক লাখ টাকা থাকলেই ৮শ টাকা সরকার কেটে নেবে। এ প্রস্তাবকে প্রায় সবাই সরকারের জনগণের পকেট কাটার সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন। কারণ এমন বহু দরিদ্র লোক আছেন যারা দীর্ঘদিন কষ্ট করে বিশেষ কোনো কাজের জন্য ব্যাংকে এক লাখ বা দু’লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। এখন তাদের কাছ থেকে যদি এ হারে টাকা কেটে নেয়া হয়, তাহলে সেটাকে এক ধরনের জুলুম বলা বোধকরি অসঙ্গত হবে না। যদিও অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত দুইমন্ত্রী ও প্রস্তাবটি চুড়ান্ত নয় এবং বাজেট পাশের সময় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। হয়তো জনঅসন্তুষ্টির কথা ভেবে সরকার শেষ পর্যন্ত আমানতের আবাগারি শুল্ক প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করবে।
ঘোষিত বাজেটকে যদি উচ্চভিলাষী ও নির্বাচনী বাজেট হিসেবে অভিহিত করা হয় তাহলে তা অতিশয়োক্তি হবে বলে মনে হয় না। কারণ, বাজেটে এমন সব প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে যা মানুষকে প্রলোভিত করার প্রচেষ্টারই নামান্তর। কিন্তু রাজস্ব আয় বাড়াতে গিয়ে মানুষের পকেটে যে সরকার হাত দিয়ে বসেছে তা বোধ হয় খেয়াল করা হয়নি। এমনিতেই বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া অবস্থায় চলছে। বাজেটের পর তা অতিমাত্রায় লাফাতে শুরু করতে পারে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। তা আরো বাড়বে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে। চালের বাজার অস্থির। মজুদও সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এমন এক পরিস্থিতিতে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নামে জনসাধারণের ওপর করের যে বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার যে বিশালাকৃতির বাজেট দিয়েছে, তা যদি শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। একদিকে যদি এ বাজেট বাস্তবায়নে তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে জনমনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত: যদি ভ্যাট ও করের বেড়াজাল থেকে সাধারণ মানুষকে অব্যাহতি দেয়া না হয়, তাহলে তারাও রুষ্ট হবে সরকারের ওপর। আর এর অবশ্যাম্ভাবী প্রতিক্রিয়া পড়বে আগামী নির্বাচনে। মনে রাখা দরকার, চলতি মেয়াদে বর্তমান সরকারের এটাই শেষ বাজেট, যেটা বাস্তবায়নের পূর্ণ সুযোগ তাদের হাতে রয়েছে। যদিও ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরের বজেট ঘোষণার সুযোগ তারা পাবে, তবে তার পুরোটা বাস্তবায়নের আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর সে নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে সে বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তাবে। ফলে ঘোষিত এ বাজেটের সঙ্গে বর্তমান সরকারের আগামী রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে। সে হিসেবে এ বাজেট প্রস্তাবকে রাজনৈতিকভাবে সুচিন্তিত বলার কোনো অবকাশ নেই। বরং বিশালতা দিয়ে চমক সৃষ্টি করার এক ধরনের অপরিনামদর্শী চিন্তাভাবনার বহি:প্রকাশ বলা চলে।
জনগণের জন্য রাজনীতি, জনগণের জন্যই বাজেট। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট জনগণের কল্যাণচিন্তা মাথায় রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে এমন মনে হচ্ছে না। তাই আমরা মনেকরি জনগণের জীবনযাত্রা যাতে অসহনীয় হয়ে না উঠে সেজন্য ঘোষিত বাজেটে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা দরকার। অন্যথায় এ বাজেট সরকারের জন্য শুভ ফল বয়ে নাও আনতে পারে।