নিজস্ব প্রতিবেদক:
এ থেকেই বোঝা যায় আল্লাহর ওপর ভরসা করার ফযীলত ও মর্যাদা কী! তাঁর সাথে হৃদয়ের সম্পর্ককে গভীর করার গুরুত্ব কতটুকু! দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় বিষয়ের কল্যাণ লাভ ও ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য সঠিক ভাবে অন্তর থেকে আল্লাহর ওপর নির্ভর করা। বান্দা তার প্রতিটি বিষয় আল্লাহর উপর সোপর্দ করবে। ঈমানে এই দৃঢ়তা আনবে যে, দান করা না করা, উপকার-অপকার একমাত্র তিনি ছাড়া আর কারো অধিকারে নেই।
আল্লাহ তাআ’লা মুমিন বান্দাদেরকে তাওয়াক্কুলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত উল্লেখ করেছেন। তার মর্যাদা ও ফলাফল উল্লেখ করেছন। আল্লাহ বলেন: “তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকে তবে আল্লাহর উপরেই ভরসা কর।” [সূরা মায়েদা- ২৩] তিনি আরও বলেন: “মু’মিনগণ যেন একমাত্র আল্লাহর উপরেই ভরসা করে।” [সূরা তওবা- ৫১]তিনি আরও এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হবেন।” [সূরা ত্বলাক- ৩] তিনি আরও বলেন: “যখন তুমি দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করবে, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালবাসেন।” [সূরা আল ইমরান- ১৫৯]
হাদীস গ্রন্থসমূহেও তাওয়াক্কুলের গুরুত্ব ও তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ওমর বিন খাত্তাব (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা যদি সঠিকভাবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে তবে তিনি তোমাদের রিযিক দান করতেন- যেমন পাখিকে রিযিক দান করে থাকেন- তারা খালি পেটে সকালে বের হয় এবং পেট ভর্তি হয়ে রাতে ফিরে আসে।” (আহমাদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনু মাজাহ)
হাফেজ ইবনু রজব (র:) বলেন, তাওয়াক্কুলের ক্ষেত্রে এ হাদীসটিই হল মূল। আর তাওয়াক্কুলই হল জীবিকা পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” [সূরা ত্বালাক-২, ৩]
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেন, “কোন প্রাণী তার নির্দিষ্ট রিজিক পরিপূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যু বরণ করবে না। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং রিজিক অনুসন্ধানের জন্য সুন্দর (বৈধ) পন্থা অবলম্বন কর। যা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তা গ্রহণ কর,আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ কর।” (ইবনু মাজাহ, হাকেম ও ইবনু হিব্বান)
ওমর (রা:) বলেন, “বান্দা এবং তার রিজিকের মধ্যে একটি পর্দা রয়েছে। সে যদি অল্পে তুষ্ট হয় এবং তার আত্মা সন্তুষ্ট হয় তবে তার রিজিক তার কাছে সহজে আগমন করবে। আর যদি সীমালঙ্ঘন করে এবং উক্ত পর্দাকে ফেড়ে ফেলে, তবে তার নির্দিষ্ট রিজিকের অতিরিক্ত কোন কিছু তার নিকট পৌঁছবে না।”
এক গবেষক বলেন: “তুমি আল্লাহর ওপর ভরসা কর, রিযিক তোমার কাছে ক্লান্তি ও অতিরিক্ত কষ্ট ছাড়া সহজেই এসে যাবে।” এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর ওপর ভরসার সাথে আবশ্যক হল, জীবিকার উপায়-উপকরণ অনুসন্ধান করা ও কাজ করা- ভরসা করে বসে না থাকা। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আর মু’মিনগণ যেন আল্লাহর ওপরই ভরসা করে।” [সূরা মায়েদা-১১]
এখানে ভরসা করার সাথে সাথে আল্লাহকে ভয় করার কথা বলা হয়েছে। আর তা নির্দেশিত যাবতীয় বিষয়ের উপকরণকে শামিল করছে। সুতরাং নির্দেশিত উপকরণ অবলম্বন না করে বা কাজ না করে শুধু ভরসা করে বসে থাকা বিরাট ধরনের অপারগতা- যদিও এতে তাওয়াক্কুল পাওয়া যায়। সুতরাং কোন বান্দার জন্য উচিত নয় যে, ভরসাকে অপারগতায় রূপান্তরিত করবে অথবা অপারগতাকে ভরসায় রূপান্তরিত করবে। বরং যে সমস্ত উপকরণ সে অবলম্বন করবে তার মধ্যে ভরসাও শামিল থাকবে।
এ অর্থে একটি হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। আনাস (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! উটটিকে বাঁধার পর আল্লাহর ওপর ভরসা করব? নাকি আল্লাহর ওপর ভরসা করে (না বেঁধেই) ছেড়ে দিব? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: “আগে তা বেঁধে দাও,তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা কর।” (তিরমিজি)
এক্ষেত্রে একদল লোক বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে (প্রয়োজনীয় উপকরণ অবলম্বন না করে, কাজ না করে,পরিশ্রম না করে) নিজেদের অপারগতাকে ভরসা ভেবেছে, আর তাকেই ওজর বা ছুতা হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে নিজের এবং পরিবারের অনেক অধিকার- ওয়াজিব বিষয় বিনষ্ট করেছে। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “কোন ব্যক্তির পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, যাদের খরচ বহন করা তার ওপর আবশ্যক তাদেরকে বিনষ্ট করা তথা তাদেরকে প্রয়োজনীয় খরচ না দেয়া।” (আবু দাউদ)
এদের উদ্দেশ্য করে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চাইতে অধিক উত্তম ও বেশি প্রিয়। অবশ্য উভয়ের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে। উপকারী বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হবে এবং তা হাসিল করার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবে, অপারগতা প্রকাশ করবে না। যদি কোন ক্ষতি হয়ে যায়, তবে কখনই এরূপ বলবে না যে, ‘যদি’ আমি এটা করতাম তবে এরূপ এরূপ হত। বরং তখন বলবে, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি যা চান তাই করেন। কেননা ‘যদি’ কথাটি শয়তানের দরজা উন্মুক্ত করে।” (সহিহ মুসলিম)
উল্লেখ্য যে, ভরসার ক্ষেত্রে মানুষের দুর্বলতা একমাত্র তাক্বদীরের প্রতি ঈমানের দুর্বলতা থেকেই সৃষ্টি হয়। কেননা মানুষ যখন তার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে, আর তিনি যা ফায়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যায় ও তা পছন্দ করে, তাহলে সে প্রকৃতভাবে তাওয়াক্কুল বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ওপর ভরসা করে এবং তার সাথেই স্বীয় হৃদয়কে সংশ্লিষ্ট করে, তবে নিঃসন্দেহে সে লাঞ্ছিত হবে, স্বীয় মহান রব থেকে উদাসীন।
ইবনে মাসউদ (রা:) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “কোন ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, অতঃপর তার অভাবের কথা মানুষের কাছে পেশ করে, তবে তার অভাব দূর করা হবে না। আর যে ব্যক্তি তা আল্লাহর কাছে পেশ করে, অনতিবিলম্বে আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত করে দিবেন।” (আবু দাউদ )
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র:) বলেন: কোন মাখলুকের কাছে যে ব্যক্তি আশা করবে এবং তার ওপর ভরসা করবে, তার উক্ত ধারণা নিঃসন্দেহে বাতিল হবে এবং সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর সে হবে মুশরিক। আল্লাহ বলেন, “আর যে কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।” (সূরা হাজ্জ-৩১)
শায়খ সুলায়মান বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল ওয়াহাব (র:) বলেন: তাওয়াক্কুল দুপ্রকার:
১) এমন বিষয়ে তাওয়াক্কুল করা- যে ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কারো কোন ক্ষমতা নেই। যেমন, কোন কোন মানুষ মৃত ব্যক্তি এবং তাগুতের ওপর ভরসা করে এই আশায় যে, তারা তাদেরকে সাহায্য করবে, তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করবে, তাদের জন্য শাফাআত করবে। এগুলো সবই বড় শিরক যা ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে বের করে দিবে।
২) বাহ্যিক উপায়-উপকরণ ও বস্তুর ওপর ভরসা করা। যেমন কোন আমীর বা বাদশার ওপর ভরসা করা এমন বিষয়ে যা বাস্তবায়নের ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন। যেমন চাকরীর ব্যবস্থা করা বা নির্দিষ্ট কোন বিপদ দূর করা। এটা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
বৈধ ভরসা হল- একজন মানুষ অপরজনকে তার পক্ষ থেকে কোন কাজ আদায় করার দায়িত্ব দেয়া। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি উক্ত বিষয়ে সামর্থ্য রাখবে। এক্ষেত্রেও সে ব্যক্তির উপর পুরাপুরি নির্ভর করবে না। বরং উক্ত বিষয় বাস্তবায়নের জন্য সে নিজে এবং ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে।
তাওয়াক্কুলের বাস্তবায়ন এবং বৈধ উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে হৃদয়কে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য এ উদাহরণটি উল্লেখযোগ্য: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরতের সময় মদিনার দিকে যাওয়ার জন্য মক্কা থেকে উল্টা দিকে গমন করেন। আর তা ছিল রাতের আঁধারে। অতঃপর তাঁরা ‘ছওর’ নামক গুহায় আত্মগোপন করেন। আবু বকর (রা:) নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হিজরতের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যখন ‘গারে ছওরে’ ছিলাম তখন আমি উপর দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম মুশরিকদের পা আমাদের মাথার ঠিক উপরেই। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের কেউ যদি নিজের পায়ের দিকে তাকায় তাহলেই আমাদের দেখতে পাবে। তখন তিনি আমাকে বললেন, “আমাদের দুজন সম্পর্কে তোমার ধারণা কি হে আবু বকর! আল্লাহ আমাদের তৃতীয় জন। অর্থাৎ আমাদের সাহায্যকারী।” (বুখারী ও মুসলিম)
যে কথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেছেন, “যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (সূরা তওবাহ- ৪০)
সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করবে, সে অকল্পনীয়ভাবে তার মর্যাদা লাভ করবে, তার ফলাফল ভোগ করবে। আর সে হবে সর্বাধিক উন্মুক্ত হৃদয়ের মানুষ, সবচাইতে সুখী মানুষ। আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা ত্বালাক-৩) আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর ওপর সঠিকভাবে ভরসা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।