২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১১:৫৫

উত্তম চরিত্র ও কোরআনের ৩ আদেশ

ধর্ম ডেস্ক :

পবিত্র কোরআনুল কারিমের এক মৌলিক শিক্ষা হচ্ছে ‘আদব’ বা আচরণবিধি। কোরআনের এ শিক্ষা এতই বিস্তৃত যে, জীবনের কোনো অঙ্গনই এর বাইরে নেই। এই বিস্তৃতিকে দুই বাক্যে ধারণ করতে হলে বলা যায়, খালিক তথা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে আচরণ এবং মাখলুক তথা সৃষ্টিকূলের সাথে আচরণ।

ইসলামী আদব ও আচরণবিধির বৈশিষ্ট্য ও বিস্তৃতি সম্পর্কে আলাদা আলোচনা প্রয়োজন। এখানে শুধু একটি বিষয়ে কিছু আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। সুরাতুল আ’রাফে ১৯৯-২০০ আয়াতদ্বয়ের তাফসিরে অন্যান্য সুরার আরও কিছু আয়াত উল্লেখ করে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুফাসসির আল্লামা ইবনে কাছীর (রাহ.) বলেছেন, ‘সুরা আরাফ, সুরা মুমিনূন ও সুরা হা-মীম আসসাজদার এ তিন আয়াত এক বিশেষ প্রসঙ্গে দিক-নির্দেশনা দেয়। আর তা হচ্ছে, অবাধ্য ও ঔদ্ধত মানুষের সাথে উত্তম আচরণ। আল্লাহ তা’য়ালা এ নীতি শিখিয়েছেন। কারণ এর দ্বারা ওই ব্যক্তি তার ঔদ্ধত্য থেকে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।’ (তাফসিরে ইবনে কাছীর ২/৩৪৬)

ইবনে কাছীর (রাহ.)- এর এ উক্তির অনুসরণে আমরা এ আয়াতগুলোর শিক্ষা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করব। ইনশাআল্লাহ। প্রথমে সুরাতুল আরাফ থেকে ইরশাদ হয়েছে,
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘আল্লাহ’তাআলা এ আয়াতগুলোতে হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলছেন, আপনি ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করুন এবং মানুষকে ভালো বিষয়ের আদেশ করুন আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন। যদি শয়তানের পক্ষ হতে কোনো প্ররোচণা আপনাকে বিদ্ধ করে, তবে আল্লাহর শরণ প্রার্থনা করুন। তিনি তো সব শোনেন, সব জানেন।’

প্রথম আয়াতে তিনটি আদেশ করা হয়েছে।
১. خذ العفو অর্থাৎ মানুষের পক্ষে যা সহজে সম্ভব হয় তা কবুল করুন। ‘খুয’ মানে গ্রহণ করুন, কবুল করুন। ‘আল আফওয়া’ মানে যা সহজে সম্ভব হয়।

আরবি ভাষাবিদরা বলেন, ع ف و ধাতুমূলে ‘ছেড়ে দেওয়া’ ও ‘ছাড় দেওয়া’র ভাব আছে। ‘ক্ষমা করা’ অর্থে- এ শব্দের যে ব্যবহার তাতেও এ ভাব প্রকাশিত। কারণ, ক্ষমা করা মানে ছেড়ে দেওয়া, শাস্তি না দেওয়া।

আল্লাহর রাস্তায় খরচের বিষয়ে সুরা বাকারার যে প্রসিদ্ধ আয়াত তাতেও العفو (আল আফও) শব্দটি আছে।

يسئلونك ما ذا ينفقون قل العفو

‘তারা আপনাকে জিজ্ঞাসা করে কী খরচ করবে। বলুন, ‘উদ্বৃত্ত’ (যা সহজে খরচ করা যায়)।’ (সুরা বাকারা ২ : ২১৯)

আরবের এক জ্ঞানী কবির কবিতার একটি পংক্তি-
خذى العفو تستديمى مودتى + ولا تنطقى فى سورتى حين اغضب

এ পংক্তির একটি শব্দে ‘খুযিল আফওয়া’। অর্থাৎ আমার সাথে কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়ি কর না বরং আমার পক্ষ হতে সহজভাবে যা সম্ভব হয় তা-ই কবুল কর। এতে আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে এবং তোমার প্রতি আমার ভালবাসা অটুট থাকবে।

সামষ্টিক জীবনের এ অনেক বড় মূলনীতি যা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে কোরআন আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। সহীহ বুখারীতে আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর (রা.) বলেন,
ما أنزل الله إلا في أخلاق الناس وفى رواية: أمر الله نبيه ان يأخذ العفو من أخلاق الناس

অর্থাৎ, এ আয়াত নাযিল হয়েছে মানুষের কর্ম ও আচরণের বিষয়। আল্লাহ তাঁর নবীকে আদেশ করেছেন, তিনি যেন কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রেও মানুষের পক্ষে যা সহজ তা কবুল করেন। (সহীহ বুখারী, ৪৬৪৩, ৪৪)

সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন ছাড় দেয়া হয়েছে, তেমনি আচরণের ক্ষেত্রেও ছাড় দেয়া হয়েছে। তো এ আয়াতের শিক্ষা, সহজ হওয়া এবং উদার হওয়া। সবার কাছ থেকে সব সময় উচ্চ মানের কর্ম ও আচরণ প্রত্যাশা না করা। যতটুকু করছে বা করতে পারছে, আশানুরূপ না হলেও তার কদর করা ও কবুল করা। কড়াকড়ি ও কঠিন আচরণ থেকে বেঁচে থাকা।

তদ্রূপ আনুগত্যের সাধারণ পর্যায় ও আন্তরিকতার সাধারণ প্রকাশে সন্তুষ্ট থাকা। বেশি চাপাচাপি না করা, বেশি অনুসন্ধান না করা এবং আন্তরিকতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রত্যাশা না করা।

দ্বীনী তরক্কী বা দুনিয়ার উন্নতির ক্ষেত্রে অধীনস্ত ও সংশ্লিষ্টদের সময় দেওয়া, অবকাশ দেওয়া ও ধৈর্যের সাথে চেষ্টা করা। যতটুকু উন্নতি হচ্ছে তা কবুল করা, একে তাচ্ছিল্য না করা, প্রত্যাখ্যান না করা। অক্ষমের অক্ষমতা ও বুদ্ধিহীনের বুদ্ধিহীনতা ক্ষমা করা। ওজর প্রার্থীর ওজর কবুল করা। অব্যাহতি প্রার্থীকে অব্যাহতি দেওয়া। প্রত্যাবর্তনকারীকে গ্রহণ করা। সন্ধিপ্রার্থীর সন্ধির প্রস্তাব কবুল করা, ক্ষমাপ্রার্থীকে ক্ষমা করা। এসবই সহজতা ও উদারতার বিভিন্ন দিক।

সহীহ বুখারীতে আছে, বিখ্যাত তাবেয়ী ইবরাহীম নাখায়ী (রাহ.) সালাফের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন,
كانوا يكرهون ان يستذلوا فإذا قدروا عفوا

তাঁরা দুর্বল প্রতিপন্ন হওয়াকে অপছন্দ করতেন। এরপর যখন (প্রতিশোধ গ্রহণে) সক্ষম হতেন তখন ক্ষমা করে দিতেন। (সহীহ বুখারী, বাবুল ইনতিছার মিনায যালিম)

ইহইয়াউল উলুমে হযরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে একটি উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে,
عليكم بالحلم والاحتمال حتى تمكنكم الفرصة، فإذا امكنتكم الفرصة فعليكم بالصفح والافضال
অর্থাৎ, তোমরা সহ্য কর ও সহনশীল হও সুযোগ আসা পর্যন্ত। আর যখন প্রতিশোধের সুযোগ আসে তখন ক্ষমা কর এবং অনুগ্রহ কর। (ইয়াহইয়াউ উলুমিদ্দীন ৩/১৮৪)

লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, যিনি আল্লাহ পাকের এ সনদ পেয়েছেন, ‘ইন্নাকা লা’আলা খুলুকিন আযীম’ (নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী), তাকেই আল্লাহ পাক আদেশ করছেন- খুযিল আফওয়া। সহজ হোন, উদার হোন। ক্ষমাপরায়ণ হোন।

তাহলে কে আছে যে কোরআনি এ তরবিয়ত থেকে বে-নিয়ায? অতএব তাকে আদেশ করে উম্মতকে আরও গুরুত্বের সাথে তা শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

আল্লার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِنَ اللَّهِ لِنْتَ لَهُمْ وَلَوْ كُنْتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانْفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের দয়ায় আপনি আপনার সঙ্গীদের প্রতি বিনম্র হয়েছেন, কোমল হয়েছেন। আপনি যদি কর্কশ স্বভাবের, কঠিন হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার চারপাশ থেকে সরে পড়তো। কঠিন হৃদয় কর্কশ স্বভাবের মানুষের চারপাশে লোকজন থাকে না।

সব মানুষ কোমল ব্যবহার পেতে চায়। কিন্তু, সবাই অন্যের সাথে কোমল ব্যবহার করতে পারে না। আমি যখন অন্যের কাছে কোমল ব্যবহার চাই তখন আমারও কর্তব্য অন্যের সাথে কোমল ব্যবহার করা।

রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোমল আচরণ, নরম ব্যবহার, উদারতা, সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এসব শুধু তাঁর সাহাবীদের সাথেই ছিল না, সকল মানুষের সাথেই ছিল। দেখুন, কুফর শিরকের সাথে তো কোনো সমঝোতা চলে না। ঈমান আর কুফরের মাঝে সন্ধিও হতে পারে না। ঈমান আলো আর কুফর অন্ধকার। ঈমান এসেছেই কুফরকে দূর করার জন্য। আর রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আল্লাহর নবী। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। সর্বশেষ নবী। তিনি এসেছেন ঈমান ও তাওহীদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। সুতরাং কুফর-শিরকের সাথে তার কোনো সন্ধি বা সমঝোতার প্রশ্নই অবান্তর। কিন্তু, এরপরও এই সকল সীমারেখার মাঝেও রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত আচরণ ছিল কোমল।

একবারের ঘটনা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) তাঁর নিকট বসে আছেন। এমন সময় এক ইহুদী এসে সালাম দেওয়ার ভান করে বললেন, ‘আসসামু আলাইক।’ সালামের সঠিক শব্দ হচ্ছে ‘আসসালামু আলাইকুম’ যার অর্থ, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর ‘আসসামু আলাইক’ অর্থ, তোমার মরণ হোক। ইহুদি এ কাজ করলেন মশকরা করার উদ্দেশ্যে, পরে এ নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্যে।

আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) খুব রাগ হয়ে গেলেন এবং ওই ইহুদিকে তিরস্কার করলেন। আর রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে শুধু বললেন, ‘ওয়া আলাইক’। এরপর চুপ করে রইলেন। উম্মুল মুমিনীন যখন খুব রাগান্বিত হয়ে তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, থাম আয়েশা! কোমলতা অবলম্বন কর। -সহীহ বুখারী ২/৮৯১ (৬০৩০)

এ প্রসঙ্গে অন্য হাদীসে তাঁর যে কথাটা এসেছে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
إِنَّ الرِّفْقَ لاَ يَكُونُ فِى شَىْءٍ إِلاَّ زَانَهُ وَلاَ يُنْزَعُ مِنْ شَىْءٍ إِلاَّ شَانَهُ
অর্থাৎ কোমলতা যেখানেই থাকবে সেটাই হবে সৌন্দর্যমণ্ডিত। আর যেখান থেকেই তা উঠিয়ে নেওয়া হবে, সেটাই হবে দোষযুক্ত।- সহীহ মুসলিম (২৫৯৪)

তো এই আয়াতে আল্লাহ’তাআলা যেমন হযরত রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সহজ উদার ও ক্ষমাশীল হওয়ার আদেশ করেছেন তেমনি তাঁর মাধ্যমে তাঁর পুরো উম্মতকেও আদেশ করেছেন।

এরপর দ্বিতীয় কথা বলেছেন, ভালো কাজের আদেশ করুন। অর্থাৎ ক্ষমাশীলতা, উপকারিতা কোমলতার অর্থ এই নয় যে, কেউ কোনো মন্দ কাজ করলে তাকে বাধা দিবেন না, তাকে ভালো কাজের দিকে আহবান করবেন না বরং উদারতার পাশাপাশি ভালো কাজেরও আদেশ করুন।

দ্বীন ও ঈমান শিক্ষা দিন। আখলাকে হাসানা সম্পর্কে সচেতন করুন। পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, অনাথ-অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো, অসুস্থ-বিপদগ্রস্তের সেবা ও সহযোগিতা প্রভৃতি সৎ গুণে উদ্বুদ্ধ করুন। ভালো কাজে সহযোগিতা করুন, সঠিক পরামর্শ দিন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে সুপারিশ করুন। দুনিয়ার বিষয়ে আখিরাতের বিষয়ে কল্যাণের পথপ্রদর্শন করুন। মন্দ ও অকল্যাণ সম্পর্কে সাবধান করুন। সব রকমের ক্ষতিকর চিন্তা, বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ থেকে মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করুন, ইত্যাদি।

তৃতীয় কথা বলেছেন, মূর্খদের উপেক্ষা করুন। অর্থাৎ মূর্খদের আচরণে ভ্রূক্ষেপ করবেন না।

এটা অনেক বড় মূলনীতি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু অনেক বড় দায়িত্বের অধিকারী। তাঁর দায়িত্ব অনেক বিস্মৃত। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য অনেক রকমের মানুষের সাথে অনেক ধরনের আচরণের মুখোমুখী তাঁকে হতে হবে সেজন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মূলনীতি বলে দিলেন যে, মূর্খদের উপেক্ষা করুন।

ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর অনেক ব্যাখ্যা হতে পারে। যেমন: মূর্খদের সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ থেকে বিরত থাকা। তাদের সকল কথার জবাব না দেয়া। কত জবাব দেয়া হবে? মূর্খতার তো কোনো সীমা নেই। মূর্খতাসূলভ আচরণেরও কোনো শেষ নেই। আর জবাব তো হয় ওই সকল বিষয়ের, যেখানে কোনো ভুল বুঝাবুঝি আছে কিংবা কোনো অস্পষ্টতা আছে। ভুল শুধরে দেয়ার জন্য, ভ্রান্তি নিরসনের জন্য কিংবা কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য জবাব দেয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু, যে বুঝেশুনে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে, মূর্খতাসূলভ কথা বলে তাকে কোনো জবাব দেয়ার দরকার নেই।

এ প্রসঙ্গে ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) থেকে কিছু পংক্তি বর্ণনা করা হয়;
قالوا سكت وقد خوصمت قلت لهم + إن الجواب لباب الشر مفتاح
فالعفو عن جاهل أو أحمق ادب + نعم وفيه لصون العرض اصلاح
إن الأسود لتخشى وهى صامتة + والكلب يحثى ويرمى وهو نباح

তারা বলল, বিবাদ-বিদ্ধ হয়েও তুমি চুপ রইলে! আমি বললাম, জবাব তো মন্দের দুয়ার খোলে। মূর্খ আর বুদ্ধিহীনকে এড়িয়ে যাওয়াই তো আদব। আর হ্যাঁ, মর্যাদা রক্ষার কারণে এতেই তো হয় সম্পর্ক রক্ষা। দেখ, সিংহ যখন নীরব তখনও সে ভীতপ্রদ। আর কুকুর যখন চিৎকার করে তখনও ধিকৃত ও বিতাড়িত। (দলীলুল ফালিহীন ৩/৯৯)

এ তো হলো জবাব না দেয়া। এরপর হাদীস শরীফে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও শিখিয়েছেন,
صل من قطعك وأعط من حرمك واعف عمن ظلمك
যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তুমি তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন কর। যে তোমাকে বঞ্চিত করে তুমি তাকে দান কর। আর যে তোমার উপর জুলুম করে তুমি তাকে ক্ষমা কর। (মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৭৪৫২)

তো এ এক মূলনীতি যার প্রয়োগ ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। পরের আয়াতে আল্লাহতা’আলা বলেন,
وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
মূর্খদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতে নিষেধ করা হল। কিন্তু, অন্যের মূর্খতাসূলভ আচরণে ক্রোধ আসা স্বাভাবিক। তখন কী করণীয়? ক্রোধ তো আসতেই পারে এবং এটা মানবীয় বিষয়। ক্রোধ একেবারে না থাকাও দোষণীয়। আবার বেশি থাকাও দোষণীয়। ক্রোধ একটা প্রবণতা। এটাকে ভালো ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। মন্দ ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে এবং ভালো কাজে ব্যবহার করা হলে এর দ্বারা সুফল লাভ হয়। আর এটাকে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এবং যথেচ্ছ ব্যবহার করা হলে এটা মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হয়।

তো রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা’আলা বলছেন, শয়তান যদি আপনার মনে ক্রোধ জাগ্রত করে- তাহলে আপনি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। আল্লাহ আপনাকে আশ্রয় দিবেন। আপনার ডাকে সাড়া দিবেন। কারণ, তিনি সব শুনেন সব জানেন। যারা খাঁটি মনে ইখলাসের সাথে আল্লাহ তা’আলার কাছে আশ্রয় চায়, আল্লাহ পাক তাকে আশ্রয় দেন।

তো রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে যদি একথা হয় তাহলে আমাদের ব্যাপারে কী কথা হবে!

মূলতঃ উম্মতকে সাবধান করা হচ্ছে যে, এমন পরিস্থিতি আসবে যখন তোমার সীমালঙ্ঘন করতে ইচ্ছা হবে, জুলুম করতে ইচ্ছা হবে, একজন একটা কথা বলবে যার জন্য তোমার তিনটা কথা বলতে ইচ্ছা করবে, এমনও তো হয় যে, একজন একটা গালি দেয় যার কারণে তার পূর্বপুরুষকেসহ গালি দেয়া হয়। তো শয়তান এভাবে মানুষকে উস্কানি দেয়, জুলুমের প্রতিবাদে আরও বেশি জুলুম করার জন্য শয়তান মানুষকে প্ররোচিত করে। এই সময় করণীয় কী? এই সময় শয়তানের যিনি প্রভু শয়তানের যিনি মালিক তাঁর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। তিনি যদি আশ্রয় দেন তাহলে শয়তান মানুষের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না।

এখানে, কোরআন মাজীদের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ পাক মানুষকে অনেক বড় আখলাকী শিক্ষা দান করেছেন। এই শিক্ষাকে যদি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণ করি তাহলে ইনশাআল্লাহ অনেক সুফল লাভ করব।

ক্রোধ যখন মানুষের মনে জাগ্রত হয় এবং মানুষ সেই ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করে, তখন শতকরা একশ ভাগ মানুষই পরে আফসোস করে। বলে, আহা এই কাজটা যদি আমি না করতাম। সুতরাং ক্রোধ প্রশমিত হওয়ার পর যেন আফসোস করতে না হয় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সেটাই আল্লাহ পাক এখানে শিখিয়েছেন যে, ক্রোধ এলে আল্লাহ পাকের আশ্রয় গ্রহণ কর।

একবার এক ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব ক্রুদ্ধ অবস্থায় দেখে বললেন, সে যদি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করত, ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’ বলত তাহলে তার এমন অবস্থা হত না। এগুলো হলো আচরণবিধি। আল্লাহ পাক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই আখলাক-আদাব শিখিয়েছেন। যেন উম্মত তাঁর কাছ থেকে এসব শিখতে পারে। আর এইসব আদাব আখলাকের মাধ্যমে তিনি উত্তম আদর্শের অধিকারী হয়েছেন।

এই আয়াত প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলেই শেষ করছি। হযরত উমর ফারুক (রা.)- এর ঘটনা। আমরা জানি, নিয়ম-নীতির বিষয়ে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর। তাঁর মজলিশে বিভিন্ন সময়ে যারা মশওয়ারার জন্য বসতেন তাদের উপাধি ছিল ‘আল কুররা’। অর্থাৎ ‘আল উলামা’। ‘কুররা’ হলো ‘কারী’ এর বহুবচন। কারী বলা হয় যারা কোরআন পাঠ করেন। এখানে উদ্দেশ্য, যারা কোরআনের আলেম। এই মজলিশের একজন ছিলেন হুর ইবনে কায়স। তার চাচা উয়াইনা ইবনে হিসন একবার গ্রাম থেকে এসে বলল, আমীরের কাছে তো তোমার বেশ মর্যাদা! তুমি তাঁর পরামর্শ সভার একজন সদস্য। তুমি আমার জন্যে একটু অনুমতি নাও- আমি তাঁর সাথে একটু কথা বলতে চাই।

হুর ইবনে কায়স হযরত উমর ফারুক (রা.)- এর কাছে অনুমতি চাইলেন। হযরত উমর অনুমতি দিলেন। তখন উয়াইনা ইবনে হিসন বললেন,
هى يا ابن الخطاب، فوالله ما تعطينا الجزل ولا تحكم بيننا بالعدل

হে খাত্তাবের বেটা! তুমি তো আমাদের সম্পদ দেও না। আর তুমি আমাদের মাঝে ইনসাফের ফায়সালাও তো কর না।

হযরত উমর রেগে গেলেন। রেওয়ায়েতে আছে,
فغضب عمر حتى هم به
অর্থাৎ তিনি তাকে পাকড়াও করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। হুর ইবনে কায়স দেখলেন যে, অবস্থা বেশি ভালো না। তিনি বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহ পাক তো বলেছেন-
خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ. وإن هذا من الجاهلين
আপনি সহজ, উদার ও ক্ষমা পরায়ণ হোন এবং ভালো কাজের আদেশ করুন। আর মূর্খদের উপেক্ষা করুন। আমীরুল মুমিনীন! এই লোক একজন মূর্খ। সুতরাং কোরআন মাজীদের আদেশ অনুযায়ী আপনার এখন তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা উচিত। রেওয়ায়েতে আছে,
والله ما جاوزها عمر حين تلاها عليه وكان وقافا عند كتاب الله
(তরজমা) আল্লাহর কসম! হুর এ আয়াত তেলাওয়াত করামাত্র ওমর (রা.) থেমে গেলেন। আর তাঁর স্বভাবই তো ছিল আল্লাহর কিতাবের সামনে থেমে যাওয়া। (সহীহ বুখারী, ২/৬৬৯)

এই হলেন সাহাবায়ে কেরাম। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কথার সামনে তাঁরা এমনই সমর্পিত হয়ে যেতেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কথার এত মর্যাদা ছিল তাঁদের কাছে। ফলে যখনই তাঁদের সামনে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কথা এসে যেত সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বলতেন, ‘আমান্না ওয়া সাল্লামনা।’ আমরা শোনলাম ও শিরোধার্য করলাম।

আমরা তো ভাবি সাহাবায়ে কেরাম এত অল্প কিছু মানুষ কীভাবে অর্ধ জাহান জয় করে ফেললেন। অথচ সংখ্যায়, অস্ত্রে, সরঞ্জামে সব সময় তাঁরা ছিলেন পিছিয়ে। এরপরও কীভাবে তারা বিজয়ী হলেন। তাঁদের বিজয়ী হওয়ার পেছনে

যে কারণগুলো ছিল, সেগুলো এই। তাঁদের অন্তরে ঈমান ও বিশ্বাসের পূর্ণ দৃঢ়তা ছিল। সেই ঈমান ও বিশ্বাস ছিল যা আজকের মুসলিম উম্মাহর মাঝে নেই। সেই ঈমান ও বিশ্বাস, সেই আনুগত্য ও সমর্পণ আবার যদি মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফিরে আসে তাহলে আবার মুসলিম উম্মাহ তার অতীতকে ফিরে পাবে।

তো মূলকথা এই যে, আমরা যেন কোরআন মাজীদ থেকে আলো গ্রহণ করি এবং কোরআন মাজীদের সামনে সমর্পিত হই। কোরআন মাজীদের হুকুম ও নির্দেশনার সামনে সমর্পিত হই। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন এবং কবুল করুন। আমীন।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :এপ্রিল ১৭, ২০১৮ ১১:১২ পূর্বাহ্ণ