লাইফ স্টাইল ডেস্ক:
চুলে ৯৭ ভাগ প্রোটিন ও ৩ ভাগ পানি থাকে। চুলের যেটুকু আমরা দেখি সেটি মৃত কোষ। কারণ এতে অনুভূতিশীল কোনো কোষ নেই। কোনো কারণে চুলের কিউটিকন নষ্ট হয়ে গিয়ে চুলের কটেক্সের আঁশগুলো খুলে গেলে চুলের আগা ফেটে যায়। এতে চুল শুষ্ক ও ভঙ্গুর হয়ে ওঠে। মূলত সে কারণেই চুল পড়তে থাকে। একজন মানুষের মাথায় গড়ে লাখ থেকে দেড় লাখ চুল থাকে এবং প্রতিটি চুল গড়ে ২ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
বংশ গত ও হরমোনজনিত কারণ ছাড়া মাথার চুল পড়লে মনে করবেন আপনার যে কোনো একটি অসুখের লক্ষণ হিসেবে চুল পড়ছে, কেননা চুল পড়া অনেক সময় অন্য অসুখের লক্ষণ হিসেবে ও দেখা যায় এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান একে অ্যালোপেসিয়া (টাক জাতীয় অসুখ) বলা হয়।
চুল পড়ার চক্র
একটা চুল গড়ে ২ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত বাঁচে, এবং যখন এ চুলটি মরে যায় তখন সেই জায়গায় আবার নতুন চুল গজায় নির্দিষ্ট চক্রের মাধ্যমে। এ চক্রকে আবার তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। ১. অ্যানাজেন, ২. ক্যাটাজেন ও ৩. টেলোজেন। চুল বৃদ্ধির মূল কাজটি হয় অ্যানাজেন পর্যায়ে থেকে যা সাধারণত ২ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত হতে থাকে। চুলের বৃদ্ধি ১.২৫ সেন্টিমিটার প্রতি মাসে অথবা ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত এক বছরে বাড়ে; কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চুলের এ বৃদ্ধির হার কমতে থাকবে। প্রতিটি চুল টেলোজেন পর্যায়ের পর পড়ে যায়।
আমাদের মাথার শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ চুল অ্যানাজেন পর্যায়ে থাকে। প্রায় ১০ থেকে ১৫% চুল টেলোজেন পর্যায়ে থাকে (ক্যাটাজন খুবই স্বল্পকালীন সাধারণত ২ সপ্তাহ) এবং এরপরই শুরু হয় টেলাজেন পক্রিয়া যা ২ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত হয়। টেলোজেন পর্যায়ের পর একটি চুলের গোড়ায় নতুন চুলের আবির্ভাব ঘটে এবং পুরনো চুলটি পড়ে যায়। এভাবে নতুন চুলটি অ্যানাজেন পর্যায়ে জন্ম নিয়ে জীবন চক্র শুরু করে।
যদি সে সময় যে কোনো কারণে টেলোজেন পর্যায় দীর্ঘতর হয় তা হলে চুল বেশি পড়বে। এ ছাড়া চুলের ফলিকল শুকিয়ে গেলে নতুন চুল নাও গজাতে পারে তখনই মাথায় টাকের সৃষ্টি হয়। তখন চুল পড়ার জন্য চুলের গোড়ার বা ফলিকলে একটি এনজাইম তৈরি হয়, যার নাম ফাইভ আলফা রিডাকটেজ। এ এনজাইম রক্তে অতিবাহিত হরমোন টেস্টস্টেরনকে ডাই হাইপ্রোটেস্টস্টেরনে পরিণত করে। যার আরেক নাম ডিএইচটি ( DHT)।
সাধারণত পুরুষের বেলায়ই বেশিরভাগ সময় টাক দেখা যায় তবে মহিলাদের ও টাক হতে পারে যখন একজন মহিলার মেনপজের সময় হয়ে যায় (বয়স ৩৮ থেকে ৪৮) তখন ফিমেল হরমোনের পরিমাণ কমে যায় এবং মেল হরমোন বা টেস্টোস্টেরন/এন্ড্রোজেনের আধিক্য বেড়ে যায় ও একই নিয়মে ছেলেদের মতো টাক পড়তে পারে।
শরীরের ডিএইচটি’র মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হলে চুল পড়া কমবে বা টাক জাতীয় অসুখ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। বর্তমানে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারে চুল পড়ার চিকিৎসা চলছে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এসব ওষুধ ব্যবহার করলে আর ও বেশ কয়েক বছর টাক জাতীয় অসুখকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। বাবা কিংবা মা অথবা দু’জনের কাছ থেকে আগত জিনের মিলনের কারণেই মাথার টাক বা চুল পড়ে থাকে, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যানড্রোজেনিক অ্যালোপেসিয়া বলা হয় এবং মূলত ইহা অ্যানড্রোজেন (পুরুষদের হরমোন)।
হরমোনজনিত সমস্যার কারণে
হরমোনের কম-বেশি হওয়ার কারণে চুল উঠে যেতে পারে। যেমন থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম বা বেশি হলে, গর্ভবতী অবস্থায় এবং বাচ্চার জšে§র পর হরমোনাল ভারসাম্য পরিবর্তিত হয় বলে তখন চুল বেশি পড়ে মহিলাদের। হরমোনের এ পরিবর্তন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে পুনরায় চুল গজায়। তবে তা আগের অবস্থায় যেতে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
কিছু ওষুধের কারণে
কোনো কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চুল পড়তে পারে, যেমন- জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি হঠাৎ করে সেবন ছেড়ে দেয়া, প্রেসারের ওষুধ, রক্ত তরলীকরণের ওষুধ, হরমোন, মানসিক অসুস্থতার ওষুধ ইত্যাদি।
টিনিয়া ক্যাপাইটিস
এটি এক ধরনের ফাঙ্গাল ইনফেকশন, যা স্কাল্প বা মাথার খুলিতে হয়ে থাকে। এ ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্য ওই অংশের চুল পড়ে যায়। কখনও কখনও দিনে একটি করে অ্যান্টিফাঙ্গাস ওষুধ আট থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত খেতে হতে পারে। ইনফেকশন ভালো হয়ে গেলে চুল আবার গজায়।
হেয়ার প্রোডাক্টের জন্য
খুব বেশি পরিমাণ কালারিং এজেন্ট, ব্লিচিংসামগ্রী, চুল সোজা করা বা ক্রমাগত রিবল্ডিং করানো ও ঘন ঘন চুল পার্ম করার সামগ্রী ব্যবহার করলে চুল পড়ার হার বেড়ে যায়। বিশেষ করে প্রোডাক্টগুলো যদি উন্নতমানের না হয় সে ক্ষেত্রে চুল বেশি করে পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই আবার চুল ওঠে; কিন্তু অনেক সময় হেয়ার ফলিকলের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে গেলে চুল আবার নাও গজাতে পারে।
অপারেশনের পর
শরীরে বড় কোনো সার্জারি বা অপারেশনের পর অনেক ক্ষেত্রেই চুল পড়ে যায়। এটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অপারেশনের কারণে শারীরিক পরিবর্তন অথবা মানসিক উদ্বেগের জন্য হতে পারে। সুস্থ হওয়ার পর চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে চুল আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
অসুখের কারণে চুল পড়া
কিছু অসুখে, যেমন অ্যানিমিয়া, টাইফয়েড, জণ্ডিস, ম্যালেরিয়া, ডায়াবেটিস, ভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ, বা মাথার খুসকি ইত্যাদিতে চুল পড়ে যেতে পারে। অনেক সময় অসুখ ভালো হওয়ার পরও চুল আর আগের অবস্থায় ফিরে যায় না।
খাদ্যাভ্যাস
শারীরিক নিউট্রিশনাল স্ট্যাটাসের ওপর চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। দৈনিক খাদ্য তালিকায় প্রোটিন, কার্বহাইড্রেট, ফ্যাট, মিনারেলস ও ভিটামিন পরিমিত পরিমাণে না থাকলে চুল পড়ে যায়। এছাড়া দীর্ঘদিন শরীরে কোনো একটি উপাদানের অভাবে চুল পড়তে পারে। যা সচরাচর অল্প বয়স্ক তরুণ-তরুণীদের বেলায় বর্তমানে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, হয়তো তার বিশেষ কিছু কারণের মধ্যে সামাজিক কিছু অতিরিক্ত দায়বদ্ধতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে।
কেমোথেরাপির কারণে যখন চুল পড়ে
ক্যান্সার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি দেয়ার পর চুল উঠে যায়। এর কারণ কেমোথেরাপিউটিক ড্রাগসগুলো বর্ধনশীল কোষের ওপর কাজ করে। কেমোথেরাপির প্রথম ডোজ দেয়ার দুই-তিন সপ্তাহ পর চুল পড়া শুরু হয় এবং কেমোর সর্বশেষ ডোজের তিন-চার মাস পর পুনরায় চুল গজানো শুরু হয়। তবে ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি দেয়ার পর চুল পড়লে তা আর গজায় না।
উপরে উল্লেখিত কারণে মাত্র পাঁচ ভাগ পুরুষের চুল পড়ে। বাকি চুল পড়ে অ্যানড্রোজেনিক অ্যালোপিসিয়ার কারণে (বংশগত বা হরমোনজনিত কারণে)।
চুল পড়ার সাধারণ কারণ
অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন নারীর চুল পড়া ও পুরুষের টাকের সবচেয়ে বড় কারণ। এ হরমোন সাধারণত পুরুষের শরীরে বেশি পরিমাণে থাকে। যাদের শরীরে এ হরমোনের প্রভাব বেশি, তাদেরই বেশি করে চুল পড়ে। নারীর মেনোপজের সময় ও পরে অ্যান্ড্রোজেনিক হরমোন আনুপাতিক হারে বেড়ে যায়। তখন হঠাৎ চুল বেশি করে পড়তে শুরু করে।
পুরুষের আংশিক টাক বা Pattern baldness-বংশগত কারণে পুরুষের চুল পড়া স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মেনে নিলে আর অন্য তেমন কিছু করার দরকার বলে মনে করি না। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে চুল কমতে থাকবে ইহাও এটি অবধারিত পরিবর্তন। মহিলাদেরও চুল ক্রমেই কমতে থাকে। বংশগত টাক বা অ্যান্ড্রোজেনিক অ্যালোপেসিয়া স্বাভাবিক চুল পড়বেই দ্রুত হারে। অ্যান্ড্রোজেনিক টাকের দুটো প্রধান উপাদান হল জেনেটিক প্রভাব ও পুরুষ যৌন হরমোন (টেস্টোস্টেরোন)। পুরুষের চুল পড়ার জেনেটিক প্রভাব বেশ জটিল।
মনে রাখবেন অন্যান্য যে কোনো হরমোনের কারণে টাক পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে ঠিকমতো ওষুধ সেবন করলে চুল আবার আগের মতো হয়ে যায়।
চুল পড়া সমস্যা শিশুদেরও হতে পারে, শিশু মাতৃগর্ভে আসার ৩ মাসের মধ্যে কপালে হেয়ার ফলিকিউল আসতে শুরু করে। ৪র্থ মাসে মাথা ও শরীরে হেয়ার ফলিকিউল দেখা দেয়। ১৭ সপ্তাহ ও ১৮ সপ্তাহে মুখ ও মাথার চুলের কাণ্ড দেখা দেয়। জন্মের আগমুহূর্তে নবজাতকের মাথায় মোটামুটি চুল গজিয়ে যায়। শিশু জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যে কিছু চুল পড়া শুরু হয় (পোস্ট নেটাল শেডিং) এবং এসময়ের মধ্যে শিশুর মাথায় পরিপূর্ণ চুল দেখা দেয়। বড়দের মতো শিশুদেরও নানা কারণে চুল পড়তে পারে। বিশেষ করে নেভাস সেবাসিয়াস, অ্যাপলাসিয়া কিউটিস, ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্যও চুল পড়তে পারে ইত্যাদি।
মাথায় টাক পড়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে কিছু পরীক্ষার জন্য আপনার চিকিৎসক বলতে পারেন : যদিও খালি চোখেই কারণ শনাক্ত হয় তার পর ও আবার কিছু ক্ষেত্রে ল্যাব পরীক্ষা দরকার। যেমন ছত্রাকজনিত হলে মাইক্রোস্কোপি এবং কালচার, অ্যান্ড্রোজেনিক হলে হরমোন অ্যানালাইসিস, সিফিলিস হলে ভিডিআরএল এবং টিপিএইচএ পরীক্ষা, বিশেষ ক্ষেত্রে ত্বকের পাঞ্চ বায়োপসি এবং ডায়াবেটিস হলে রক্তের সুগার পরীক্ষা।
আধুনিক চিকিৎসা
অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অ্যান্ড্রোজেনিক টাকের জন্য চুল প্রতিস্থাপনই সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা বলে মনে করেন যা খুব ব্যয়বহুল পদ্ধতি, তবে কয়েক বছরের জন্য যদি মাথায় টাক না দেখতে চান তা হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে বাজারে কিছু ওষুধ আছে তা মিনোক্সিডিল : এটি বাজারে ১%, ২% ও ৫% মাত্রায় পাওয়া যায়। এটি চুলের ফলিকলের বৃদ্ধিকাল বাড়ায়। তবে এটি শুধু এখন সক্রিয় আছে এমন ফলিকলের ওপর কাজ করে। আর যতদিন এটি ব্যবহার করা হয়, ততদিনই শুধু সুফল পাওয়া যায়। ইহা এক ধরনের লোশন বা সলিউশন যা সরাসরি মাথার ত্বকে ব্যবহার করতে হয়।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি