আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। প্রতিবারের ন্যায় এবারও দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। দিবসটি সরকারি ছুটির দিন। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পৃথক বাণী দিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এ দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে দেশবাসী সবাইকে আমরা জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে জীবন উৎসর্গকারী বীর শহীদদের এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারানো মা-বোনদের।
১৯৭১ থেকে ২০১৮। দীর্ঘ ৪৭ বছর। চার দশকেরও বেশি সময় পার করেছি আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে। ভৌগলিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির এক বিশাল স্বপ্ন ছিল ১৯৭১ সালে এদেশের মুক্তিকামী মানুষের মনে। কিন্তু চার দশক পর যদি প্রশ্ন করা হয়- আমাদের সে স্বপ্নের কতোটা পূরণ হয়েছে, তার সন্তোষজনক উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে, এ প্রশ্নের জবাবে একটি কথা অবধারিতভাবে সবাই বলবেন যে, যতোটা অগ্রগতি আমাদের হওয়ার কথা ছিল, তার অনেকাংশই অপূর্ণ রয়ে গেছে।
প্রাসঙ্গিকভাবেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি আসে কেন এমন হলো। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বিভিন্ন দেশ অতিদ্রুত উন্নয়ন-অগ্রগতি লাভ করেছে, স্বয়ম্বরতা অর্জন করেছে। এমনকি আমাদের দু’এক বছর আগে কিংবা পরে যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে তারাও আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। তারা পরিনত হয়েছে উন্নত দেশে। আমরা তাদের কাছে সাহায্য সহযোগিতার জন্য হাত পাতছি। আমাদের এ অনগ্রসরতা, পশ্চাৎপদতার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে অনৈক্য ও রাজনৈতিক বিভেদ। এ বিভেদ ও অনৈক্য আমাদের গোটা জাতিকে এমনভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে যে, জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়েও আমরা একমত হতে পারি না। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতিকে ভয়ঙ্কর বিভক্তির জালে আবদ্ধ করে ফেলছেন।
ছেচল্লিশ বছরে আমাদের প্রধান ব্যর্থতা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন তাদের হাতেই প্রথম লাঞ্ছিত হয়েছিল গণতন্ত্র। এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার মানসে যখন বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়, তখনই রোপিত হয় সর্বনাশের বীজ। লক্ষণীয় বিষয় হলো-নয় মাসের যুদ্ধের পর দেশ ও জাতির পুনর্গঠনে যেখানে প্রয়োজন ছিল সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য, সেখানে প্রথমেই রোপন করা হয় বিভেদের বীজ। বিরোধী মতাবলম্বী রাজনৈতিক দল ও সেগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। ফলে রাজনৈতিক বিরোধ রূপ নেয় শত্রুতায়। ক্ষমতাসীনদের একদেশদর্শী চিন্তাভাবনার ফলে জাতীয় ঐক্যে ধরে ফাটল। ১৯৭১ যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল মাত্র এক বছরের মাথায় সে ঐক্য বিনষ্ট হয়। সংকীর্ণ রাজনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের কথা অনেকেই বিস্মৃত হন।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর চেষ্টা করেছিলেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার। বহুদলীয় গণতন্ত্র পূন:প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে। রাজনৈতিক চিন্তাধারায়ও পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন তিনি। উন্নয়ন উৎপাদনকে রাজনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছিলেন। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের বাতাস বইতে শুরু করেছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ইতিবাচক রাজনীতি জনগণকে যেমন নাড়া দিয়েছিল, তাদেরকে আলোড়িত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল, পাশাপাশি ভিন্ন চিন্তা ভাবনার রাজনীতিকদের শঙ্কিত করে তুলেছিল। তারা শঙ্কিত ছিলেন তাদের রাজনৈতিক সংকীর্ণতার সমূহ বিপর্যয়ের কথা ভেবে। আর সেজন্য দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন নিহত হলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির পথচলা বাধাগ্রস্ত হলো। এরপর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ পুনরায় রুদ্ধ হলো গণতান্ত্রিক পথচলা। সেনাপতি এরশাদ ক্ষমতা দখল করে দীর্ঘ নয় বছর দেশকে শাসন করলেন। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখে উন্নয়নের বুলি তিনি কপচালেন ঠিকই। তবে তা কাজীর গরুর মতো খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ থাকলো, বাস্তবে পাওয়া গেলো না।
বস্তত. ’৮২’র সামরিক শাসন ছিল এদেশের গণতান্ত্রিক পথ চলার বিশাল একটি স্পীড ব্রেকার। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, নেতাদের কেনা-বেচা, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ব্যাপক দুর্নীতির বীজ তখনই রোপিত হয়। সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশের ছাত্র সমাজও গণতন্ত্রের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হয়। নয় বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ফসল এরশাদী শাসনের অবসান। এরশাদের পতনের পর এদেশের মানুষ আশা করেছিল যে, এরপর হয়তো রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে একমত হয়ে কাজ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা হতাশার চোরাবালিতেই হারিয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত।
প্রকৃতই ’৯০ এর পর জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা এবং দলীয় সংকীর্ণতার কারণে সে সুযোগ হাত ছাড়া হয়েছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও মতভেদ কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু রাজনৈতিক মত পার্থক্য যখন চিরস্থায়ী বিরোধিতায় রূপ নেয়, তখনই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আর সে দূরত্বের সুযোগ গ্রহণ করে অরাজনৈতিক শক্তি। আমাদের দেশে অনেকবার সেরকম ঘটেছে। সর্বশেষ ঘটেছে ২০০৭ সালে।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারি বাংলাদেশের জন্য ছিল রাজনৈতিক গজব। রাজনৈতিক দলগুলোর পরষ্পর বিরোধী শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান ও সহিংস পরিবেশ ক্ষমতালোভী সেনা কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করে রাষ্ট্্রক্ষমতা দখলে। জরুরি অবস্থার ছদ্মাবরণে তারা কায়েম করে সামরিক শাসনব্যবস্থা। দু’টি বছর দেশে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকে দেশে। নানা রকম পরিকল্পনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় রাজনীতি নিয়ে। চেষ্টা করা হয় রাজনীতিকদের জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে। দুর্নীতি দমনের নামে পাইকারী হারে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের গ্রেফতার, চরিত্র হনন করে কাল্পনিক কাহিনী প্রচার ইত্যাদির মাধ্যমে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের সম্বন্ধে এক ধরণের নেতিবাচক ধারনা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও আসে আঘাত। ফলে দুই বছরে দেশ পিছিয়ে যায় দুই যুগ। যার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে জাতিকে।
আজ যখন ৪৭তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপিত হচ্ছে জাতি এখনও ভয়াবহ রকম বিভক্ত। সরকার ও বিরোধী পক্ষ এমনভাবে বিভক্ত যে, সাদা চোখে এর সমস্যার সমাধান চোখে পড়ছেনা কারোরই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লেশমাত্র নাই তাদের কথাবার্তা আচরণে। গোটা দেশ যেন পরিণত হয়েছে বৃহৎ কারাগারে, একটি বধ্যভূমিতে। প্রতিদিন গুম খুন হচ্ছে। কোনো বিকার নেই সরকারের। বিরোধী দলকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার করে। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে সভা-সমাবেশ মিছিল করতে দেয়া হচ্ছে না। রাজপথে নামলেই হামলা, গুলি। তারপর মামলা ও জেল। গণতন্ত্রের নামে এক চরম স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা চেপে বসেছে জাতির কাঁধে। শ্বাসরুদ্ধকর এ পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭২-৭৫ সময়েই শুধু তুলনা চলে।
ক্ষমতাসীন সরকার একক কতৃত্বের মোহে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিস্মৃত হয়েছে। অথচ আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল একটি শোষণ বঞ্চনাধীন গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন। কিন্তু আজকের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই স্বাধীনতার প্রকৃত সুফলের স্বাদ এদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। আর সেজন্যই চারদশক পেরিয়ে এসেও একই প্রশ্ন শুনতে হয়-স্বাধীনতার সুফল পেতে আর কতোকাল অপেক্ষা করত হবে ?
তারপরও আজকের এ দিনে বাংলাদেশের মানুষ নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ হবে, অনুপ্রাণিত হবে। মহান স্বাধীনতা দিবসে তারা আশায় বুক বাঁধবে-নতুন করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবহার সুপ্রতিষ্ঠার আকাংখায়। আর সে গণতন্ত্রকে যদি সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায়, জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলেই ১৯৭১ এ লাখো শহীদের আত্মদান সার্থকতা পাবে।