সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা হয়েছে গত শনিবার। খবরে বলা হয়েছে, ওইদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মুক্তমঞ্চে এ হামলা হয়। একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাফর ইকবাল। তিনি তার আসন থেকে উঠতে যাবার মুহূর্তে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আততায়ী তার ওপর ছোরা দিয়ে আক্রমণ করে। আক্রমণকারী জাফর ইকবালের মাথার পেছন দিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ দেয়। এরপর তার পিঠে ও হাতে আঘাত করে। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ড. জাফর ইকবালকে জরুরি ভিত্তিতে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন আছেন। তার চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। চিকিৎসক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তিনি এখন শঙ্কামুক্ত।
এ বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় দেশব্যাপী নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এছাড়া দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে হামলাকারী ও এর মদতদাতাদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেছে।
ড. জাফর ইকবালের মতো বিশিষ্ট নাগরিকের ওপর এ ধরনের আক্রমনের খবরে দেশবাসী স্তম্ভিত । দীর্ঘদিন পর আবারো একটি পিলে চমকানো ঘটনা প্রমাণ করে দিল, যে চক্রটি হীন উদ্দেশ্যে দেশে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনা অতীতে ঘটিয়েছে, তারা এখনো তৎপর রয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, জাফর ইকবালের ওপর যে যুবক হামলা চালিয়েছে, তাকে সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত লোকজন আটক করেছে। তার নাম ফয়জুল। উপস্থিত লোকজন গণপিটুনী দিয়ে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে । অপর একজন মোটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধৃত যুবক বিশ্ববিধ্যালয়ের ছাত্র নয়। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসের কাছেই তার বাসা। তার পুরো পরিচয় পুলিশ জানতে পেরেছে। পুলিশ যুবকের বাড়িতে তল্লাসী চালালেও সেখানে কাউকে পায় নি। এদিকে, খবরে বলা হয়েছে, র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে বলেছে, ‘ভূতের বাচ্চা সোলায়মান’ উপন্যাসে নবী সোলায়মান (আ.)কে ব্যাঙ্গ করায়ই নাকি সে এ হামলা করেছে। তবে, তার এ ভাষ্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখতে হবে। উপন্যাসের কারণেই এই হামলা, নাকি এর পেছনে কোনো বিশেষ মহলের ইন্ধন আছে, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের।
এটি একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা সন্দেহ নেই। কেননা, ড. জাফর ইকবালের মতো মানুষেরা যখন দুর্বৃত্ত কর্তৃক আক্রান্ত হন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, সমাজে নিরাপত্তাহীনতা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, জঘন্য এ হামলার ঘটনাটি ঘটেছে প্রকাশ্য দিবালোকে এবং শ’ শ’ মানুষের সামনে। দুর্বৃত্তরা কতোটা বেপরোয়া হলে এমন দুঃসাহসী ঘটনা ঘটাতে পারে তা নিয়ে অবশ্যই ভাববার অবকাশ আছে। এটা সর্বজনবিদিত যে, দেশে এখন কারোরই জীবনের নিরাপত্তা নেই। সাধারণ মানুষ হোক, কিংবা বিশিষ্ট নাগরিক হোন, সবাই এখন সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের ভয়ে তটস্থ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলার এ অধোগতির জন্য সবাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের দিকেই আঙ্গুল তুলছে সঙ্গত কারণেই। সরকারের মন্ত্রীরা বিরতীহীনভাবে সাফল্যগাথা প্রচার করলেও তার অন্তঃসারশূন্যতা এখ পরিষ্কার। যে সমাজে মানুষের জীবনের ন্যুনতম নিরাপত্তা নেই, সে সমাজ কতটা বসবাসের উপযোগী সে প্রশ্ন তোলা নিশ্চয়ই অসঙ্গত হবে না।
ড. জাফর ইকবালের ওপর এ হামলার জন্য দায়ি ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে দেশবাসী সবাই। কেন তার ওপর এ হামলা চালনো হলো তা এখনও অজানা। এটা কি ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে হয়েছে, নাকি এর পেছনে সংঘবদ্ধ কোনো গোষ্ঠী জড়িত আছে তা এখনো পরিষ্কার নয়। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ঘটনার একদিন পরে বলেছেন, ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীরা ধর্মান্ধ। আর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জাফর ইকবালের ওপর কারা হামলা করেছে তা পরিষ্কার। যদিও হামলাকারী হিসেবে কাদেরকে তিনি সন্দেহ করছেন তা পরিষ্কার করে বলেন নি।
জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টায় যারা জড়িত তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত। এ ঘটনা নিয়ে যাতে কোনো মহল রাজনীতির ঘুটি চালাচালি করতে না পারে, সেদিকে অবশ্যই সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ফায়দা লুটার অভিপ্রায়ে যদি তদন্তের নামে কোনো গল্প ছড়ানো হয়, তাহলে মূল অপরাধীরা যেমন অধরা থেকে যাবে, তেমনি সমাজ হয়ে উঠবে আরো অনিরাপদ। আমরা এ ঘৃণ্য ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছি।