২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৫৮

চিনির অপকারিতা

স্বাস্থ্য ডেস্ক:

চিনির যেমন উপকারিতা রয়েছে, তেমনি অপকারিতাও রয়েছে। অতিরিক্ত চিনি আমাদের স্বাস্থ্যকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এ প্রতিবেদনে চিনির অপকারিতা তুলে ধরা হলো।

জীবনের আয়ু হ্রাস করতে পারে
আপনি সম্ভবত জানেন যে ক্যান্ডি বার অথবা সোডার ক্যান স্বাস্থ্যকর নয়, কিন্তু আপনি হয়তো অবগত নন যে এসবের শর্করা উপাদান কিভাবে আমাদের শরীরের ক্ষতি করছে। মাঝেমাঝে খাওয়া ঠিক আছে, কিন্তু নিয়মিত খেলে স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ফ্রান্সিসকোর একটি গবেষণায় পাওয়া যায়, প্রতিদিন ২০ আউন্স সোডা পান করা কোষের বয়স ৪.৬ বছর বেড়ে যাওয়ার সমতুল্য, যা সিগারেট স্মোকিংয়ের প্রভাবের অনুরূপ। এই কোষ বয়স্কতার সঙ্গে মানুষের সংক্ষিপ্ত জীবনকালের সম্পর্ক রয়েছে।

ইনসুলিন বৃদ্ধি করে
অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের একটি তাৎক্ষণিক ফলাফল হচ্ছে ইনসুলিন নিঃসরণ বেড়ে যাওয়া। ইনসুলিন আমাদের শরীরের রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে। হার্ভার্ড টি.এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষণা বিজ্ঞানী ভাসন্তি মালিক বলেন, ‘সোডা হচ্ছে সর্বাধিক জঘন্য কালপ্রিট। বেভারেজের শর্করা খুব দ্রুত শোষিত হয়, যার ফলে রক্ত শর্করা ও ইনসুলিন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের দিকে ধাবিত করে যেখানে শরীর সক্রিয় হতে অত্যধিক ইনসুলিন প্রয়োজন হয় এবং ব্যক্তির বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে।’ প্রাকৃতিক শর্করার (যেমন- ফলের শর্করা) অনুরূপ নেতিবাচক প্রভাব নেই, কারণ তা ফাইবারের সঙ্গে যুগ্মভাবে থাকে, ফলের ফাইবার ধীরে শর্করা শোষণে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে রাখে
যদি আপনার উচ্চ রক্ত শর্করার কোনো স্পষ্ট লক্ষণ থাকে, তাহলে হয়তো আপনি ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসের রাস্তায় আছেন। ডা. সল্টজম্যান বলেন, ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স অধিক ইনসুলিন উৎপাদনের জন্য অগ্ন্যাশয়কে প্ররোচিত করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে অগ্ন্যাশয় ক্লান্ত হতে পারে এবং পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদনের সামর্থ্য থেমে যেতে পারে। এরকম ঘটলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস ডেভেলপ হতে পারে।’

ওজন বৃদ্ধি করে
আপনার শরীরে শক্তির জন্য কিছু শর্করা প্রয়োজন হয়, কিন্তু অবশিষ্টাংশ চর্বি হিসেবে জমা হয়। চিনির সঙ্গে ওজন বৃদ্ধির সম্পর্ক আপনার স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। ডা. সল্টজম্যান বলেন, ‘কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, চিনির সঙ্গে ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতার সম্পর্ক আছে, যার ফলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বিকাশের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। এরকম কেন ঘটে তা এখনো দুর্বোধ্য, কিন্তু নিম্নমাত্রার প্রদাহের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে- যা স্থূলতা ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের কারণে হয়ে থাকে। ডা. মালিক বলেন, ‘অতিরিক্ত চিনি ভোগের কারণে পেটে মেট বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে, যা হৃদরোগের একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়।’ এছাড়া চিনিযুক্ত পানীয় পান শরীরকে অধিক চর্বি জমাতে প্ররোচিত করে।

উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে
গবেষণায় দেখা গেছে, চিনির সঙ্গে উচ্চ কোলেস্টেরল এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুর সংযোগ আছে। ডা. সল্টজম্যান বলেন, ‘উচ্চমাত্রায় চিনি গ্রহণের সঙ্গে লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (ভিএলডিএল) নামক একপ্রকার রক্তের লিপিড বৃদ্ধির সংযোগ পাওয়া গেছে, যা কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। চিনি এইচডিএল নামক উপকারী কোলেস্টরল হ্রাস করতে পারে- এইচডিএল কোলেস্টেরল হৃদপিণ্ডের সমস্যা থেকে রক্ষা করে।’ এছাড়া চিনি হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। ডা. সল্টজম্যান বলেন, ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হাইপারটেনশন সৃষ্টি করতে পারে। কিডনি, আর্টারির গঠন ও কার্যক্রম এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালনকারী মস্তিষ্কের কেন্দ্রের ওপর চিনি গ্রহণের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে এই হাইপারটেনশন হতে পারে।’

মস্তিষ্ককে প্ররোচিত করে
চিনি মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ডা. সল্টজম্যান বলেন, ‘শক্তিসমৃদ্ধ মিষ্টান্ন খাবার আপনার লিম্বিক সিস্টেম নামক মস্তিষ্কের অংশকে এসব খাবার আরো বেশি করে খাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে পারে।’ মিষ্টান্ন খাবার খেলে এসব খাবার চাওয়া ও খাওয়ার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ পায় এবং এভাবে এসব খাবার খাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ডা. মালিক বলেন, ‘চিনি মস্তিষ্কের প্লেজার সেন্টারকে উদ্দীপিত করতে পারে, যেভাবে করে ড্রাগ।’

আপনাকে ক্ষুধার্ত রেখে দিতে পারে
যেহেতু চিনি খেলে প্রকৃত পুষ্টি পাচ্ছেন না, সেহেতু আপনি ক্ষুধার্ত অনুভব করতে পারেন, অর্থাৎ চিনি আপনার প্রকৃত ক্ষুধা ধ্বংস করতে পারে না। একটি অস্ট্রেলিয়ান গবেষণায় পাওয়া যায়, অধিকতর পরিশোধিত চিনি গ্রহণে গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের প্রকৃত ক্ষুধা দূর হয়নি।

ব্রেইনের ক্ষতি করে
গবেষণায় পাওয়া গেছে, সোডা ও অন্যান্য অ্যাডেড সুগার ব্রেইনের জন্য ক্ষতিকর। ওরিগন স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি প্রাণী গবেষণায় আবিষ্কার হয় যে, অত্যধিক চিনিযুক্ত ডায়েট জ্ঞানীয় ক্ষতি বা অবনতির দিকে চালিত করে, যেমন- স্মৃতিভ্রংশতা। যুক্তরাজ্যের একটি গবেষণায় একটি টিপিং পয়েন্ট আবিষ্কার হয়েছে, যেখানে রক্ত শর্করা অ্যালেজেইমার’স রোগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এ গবেষণার লেখক ডা. ওমর কাসার বলেন, ‘ডায়াবেটিস ও ওবেসিটির ক্ষেত্রে বাড়তি চিনি যে আমাদের জন্য ক্ষতিকর তা বেশ পরিচিত একটি বিষয়, কিন্তু চিনির সঙ্গে অ্যালজেইমার’স রোগের সম্ভাব্য সংযোগের কারণেও আমাদের ডায়েটে চিনি নিয়ন্ত্রণের কথা বিবেচনা করা উচিত।’

ফ্যাটি লিভারের কারণ হতে পারে
গোপনে লিভার বা যকৃতের ক্ষতি করে এমন উপায়সমূহের একটি হচ্ছে অধিক বা অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করা। ডা. মালিক বলেন, ‘ফ্রুক্টোজ লিভারে বিপাক হয় এবং অত্যধিক চিনি গ্রহণে লিভারে চর্বি জমতে পারে- যা বিপাকীয় স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করার অন্যতম একটি পন্থা।’ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ফ্রান্সিসকো অনুসারে, বর্তমানে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এবং লিভারের ক্ষত ১৯৮০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।

দাঁতের ক্ষয় করে
ডা. স্যান্ডা মোল্ডোভান বলেন, ‘মুখের ব্যাকটেরিয়া চিনি ভালোবাসে, যেমনটা ভালোবাসি আমরা এবং তারা যখন এসব ভোজন করে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে এসিড নিঃসরণ হয়। এই এসিড দাঁতের এনামেলকে আক্রমণ করে ও ডেন্টিন নামক দাঁতের গভীর স্তরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে।’ আপনি যত বেশি চিনি খাবেন, আপনার মুখ তত বেশি অ্যাসিডিক হবে এবং দ্রুত দাঁতে ক্যাভিটি বা ক্ষয় হবে। এছাড়া চিনি খেয়ে ইস্টও বিকশিত হয়, যা মুখের কর্নার বা জিহ্বা লাল করতে পারে।

ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে
গবেষণা অনুসারে, যেসব খাবার ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতাকে আরো খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যায়, সেসবের মধ্যে চিনি অন্যতম। সাধারণ কার্বোহাইড্রেট রূপে অধিক মাত্রায় চিনি গ্রহণ গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি করে ও সংঘর্ষ সৃষ্টি করে, যার ফলে মেজাজ খারাপ হতে পারে এবং বিরক্তি-অস্থিরতা-অনিয়মিত ঘুম-প্রদাহ বৃদ্ধি পেতে পারে। এর পরিবর্তে, চর্বিহীন প্রোটিন, জটিল কার্বোহাইড্রেট এবং ওমেগা৩-ফোলেট-ভিটামিন বি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৮ ৫:৫৬ অপরাহ্ণ