৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং | ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৩২

গণতন্ত্র হত্যার কালো দিন

আজ ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন। এ দিনটি এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে গণতন্ত্র হত্যার দিন হিসেবেই পরিগণিত। ১৯৭৫ সালের এ দিনে জাতীয় সংসদে মাত্র ১৩ মিনিটের আলোচনায় পাশ করা হয়েছিল চতুর্থ সংশোধনী, যার মাধ্যমে এ দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল একদলীয় বাকশালী শাসন। ওই সংশোধনীর বলে দেশের সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তৈরি করা হয় সরকার নিয়ন্ত্রিত একমাত্র রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ, যা সংক্ষেপে বাকশাল নামে পরিচিত। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে কেড়ে নেয়া হয়। গলা টিপে হত্যা করা হয় বাক, ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে। যার ফলশ্রুতিতে এ দেশের মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার হয় খর্ব।
আজ সে গণতন্ত্র হত্যার তেতাল্লিশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ দিনটি এলে এ দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিভীষিকাময় সময়ের ছবি, যখন কারো কথা বলার অধিকার ছিল না। স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিল মানবতা। রক্ষী বাহিনী নামক এক দানবীয় বাহিনী তখন সৃষ্টি করেছিল ভয়ঙ্কর এক পরিবেশ। বিরোধী মতের কাউকেই ছেড়ে দেয়া হয়নি। হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, অথবা জীবন দিতে হয়েছে এক দলীয় শাসনের যুপকাষ্ঠে।
বলা বাহুল্য যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আপব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে এ ন্যাক্কারজনক নজির স্থাপন করেছিল। নির্বাচিত হলেই কোনো সরকার গণতান্ত্রিক হয় না আওযামী লীগ তার প্রমাণ। নিরঙ্কুশ সংক্যাগরিষ্ঠতাকে অপব্যবহারের যে নজির তারা ১৯৭৫-এ স্থাপন করেছিল, আজও সে বদঐতিহ্য তারা বজায় রেখেছে। যার প্রমাণ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ফখরুদ্দীন-মইন-এর সাথে গোপন সমঝোতায় প্রাপ্ত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অপব্যবহার। যার মাধ্যমে তারা সংবিধান থেকে সর্বজন সমর্থিত ও প্রশংসিত নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিস্থিতি ১৯৭৫-এর বাংলাদেশের পরিস্থিতি থেকে খুব একটা ভিন্ন এ কথা বলা যাবে না। বর্তমানে দেশে অঘোষিত বাকশালী শাসন চলছে- এ অভিযোগ সরকারবিরোধীরা প্রায়শই করে থাকেন। তাদের এ অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যাবে না। কেননা, দেশে এখন কথা বলার স্বাধীনতা অনেকটাই সীমিত। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে দেয় হচ্ছে না। দলটিকে রাজপথে মিছিল করতে দেয়া হয় না, সমাবেশ করতে চাইলে পুলিশ ‘অনুমতি’ দেয়না, বাধা দেয়। প্রতিদিন গ্রেফতার করা হচ্ছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের, দেয়া হচ্ছে নান ধরণের মামলা। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি কল্পনা করা যায় কি?
একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকার বিরোধী মতকে স্তব্ধ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করবে এটা ভাবা যায় না। অথচ বাংলাদেশে তাই হচ্ছে। গণতন্ত্র আজ নির্বাসনে। গণতান্ত্রিক ছদ্মাবরণে আজ স্বৈরশাসনের স্টীম রোলার চলছে বাংলাদেশে। যেন নতুন রূপে ফিরে এসেছে বাকশাল।
অথচ দেশবাসী এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের অবসান চায়। তারা চায় একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যেখানে ক্ষমতাসীনরা বিরোধী দলকে দমনে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করবে না, স্তব্ধ করে দিতে চাইবে না বিরোধী দলের প্রতিবাদী কণ্ঠকে। বলা নিষ্প্রয়োজন, তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন চোখে নিয়েই এ দেশের মানুষ একাত্তরে যুদ্ধ করেছিল, রক্ত দিয়েছিল। গণতন্ত্রকে যদি শক্তিশালী করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক শক্তি সমূহকে সহনশীল হতে হবে, গণতন্ত্রের মর্মবাণীকে হৃদয়ে ধারণ করে আচরণে প্রতিফলিত করতে হবে। যতদিন শাসকগোষ্ঠী চিন্তা-চেতনায় আক্ষরিক অর্থে গণতান্ত্রিক না হবে, ততদিন গণতন্ত্র সোনার হরিণ হয়েই থাকবে। আর সে সুযোগে বাকশাল ফিরে আসবে ভিন্ন নামে, ভিন্ন রূপে।

প্রকাশ :জানুয়ারি ২৪, ২০১৮ ৮:১৭ অপরাহ্ণ