স্বাস্থ্য ডেস্ক:
বয়সকালে হাড়ের সন্ধিস্থলে ও মাংসপেশিতে ব্যথা হয়। যাকে সহজ ভাষায় বাতের ব্যথা বলা হয়। ‘বাত’ শব্দটি আমাদের সমাজে বহুল আলোচিত শব্দ। শরীর ব্যথা বিশেষ করে যে কোনো জয়েন্ট বা গিরায় ব্যথা হলেই তাকে আমরা বাত বলে থাকি। এছাড়া ঘাড়, কোমরে ব্যথা এবং এই ব্যথা হাত কিংবা পায়ের দিকে ছড়িয়ে গেলেও তার নাম হয়ে যায় বাত। বাতের ব্যথা অমাবস্যায় বাড়ে, পানির জোয়ারে বাড়ে কিংবা শীতে এর প্রকোপ বেশি হয় এমন কথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশে অনেক মানুষ বাতের ব্যথায় ভুগছেন। এই ব্যথা বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। ডাক্তারের পরিভাষায় আথ্রাইটিস বলে।
এর ফলে হাড়ের বিবৃতি ঘটে। পুরুষের তুলনায় মহিলারা এই রোগে বেশি ভোগে। খাদ্য তালিকায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম গ্রহণ, ভিটামিন ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে সংশ্লেষণ না হওয়া এবং অতিরিক্ত কায়িক পরিশ্রম করার ফলে হাড় ক্ষয়ের সম্ভাবনা থাকে। পক্ষান্তরে বেশি পরিশ্রম না করার ফলে স্থূলতা মেনোপোজও অস্টিওআর্থ্রাইটিসের অন্যতম কারণ বলে ধরা যায়। ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড়ের ভেতরের অংশ ফাঁপা হয়ে যায়, ফলে শরীরের অতিরিক্ত ওজনের চাপ হাড়ের ওপর পড়ে এবং হাড় বাঁকা হতে শুরু করে। এক সময় দ্রুত তা ক্ষয় হতে হতে ভেঙে যায়। বড়দের এ সমস্যাকে অস্টিওম্যালাসিয়া বলে।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শারীরিক, মানসিক শক্তি ও দেহ কোষের কর্মক্ষমতা বা সামর্থ্য ধীরে ধীরে কমতে থাকে। টিস্যুর এই সামর্থ্য ক্রমাবনতির হার বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুপাতে হয়। ৫০/৬০ বছর বয়সের ব্যক্তিরা ভুগতে পারেন বিভিন্ন ধরনের বার্ধক্য জনিত সমস্যা ও জয়েন্ট বা মাংস পেশির ব্যথায় যাকে আমরা সহজ ভাষায় বাত বলে জানি। সাধারণত মহিলাদের ৪০ বছর পর পুরুষরা ৫০ বছর পর বয়সজনিত জয়েন্টের সমস্যায় ভুগে থাকেন। আমাদের দেশের ৫০ উর্দ্ধ জনসংখ্যার শতকরা ৬৫ ভাগ লোক ব্যথা জনিত সমস্যায় ভোগেন।
বিশেষ করে যেসব জয়েন্ট শরীরের ওজন বহন করে এবং অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয় যেমনঃ ঘাড়, কোমর, স্কন্ধ বা সোল্ডার জয়েন্ট এবং হাটু ব্যথার রোগী সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। বাতের ব্যথার অনেক কারণ রয়েছে তার মধ্যে ৯০ ভাগ হচ্ছে ‘মেকানিকেল সমস্যা’। মেকানিকেল সমস্যা বলতে মেরুদণ্ডের মাংস পেশি, লিগামেন্ট মচকানো বা আংশিক ছিড়ে যাওয়া, দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিক্স সমস্যা, কশেরুকার অবস্থানের পরিবর্তনকে বুঝায়। অন্যান্য কারণের মধ্যে বয়সজনিত হাঁড় ও জোড়ার ক্ষয় বা বৃদ্ধি, রিউমাটয়েড আথ্রাইটিস বা গেটেবাত, অষ্টিওআথ্রাইটিস, অষ্টিওপোরোসিস, এনকাইলজিং স্পন্ডাইলোসিস, বার্সাইটিস, টেন্ডিনাইটিস, স্নায়ুবিক রোগ, টিউমার, ক্যান্সার, মাংস পেশির রোগ, শরীরে ইউরিক এসিড বেড়ে গেলে, অপুষ্টিজনিত সমস্যা, শরীরের অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি।
এভাবে চলতে থাকলে আস্তে আস্তে রোগী তার দেহের জোড়ার কর্ম ক্ষমতা বা নড়াচড়ার ক্ষমতা হারায় এবং জোড়া সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে রোগী পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারে। অনেক সময় দীর্ঘদিন রোগেভোগে শরীরের মাংস পেশীগুলোও শুকিয়ে যেতে পারে।
তাই বাতের ব্যথা নিয়ে কষ্ট না পেয়ে যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসা নিতে হবে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাহারা বাতের ব্যথায় ভূগছেন তারা একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের চিকিৎসা ও পরামর্শে ভালো থাকতে পারেন। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিহীন অত্যান্ত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
চিকিৎসক আপনার রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা ও পরামর্শ দিলে আপনি অবশ্যই বাতের কষ্ট থেকে মুক্ত থাকতে পারবেন, পাশাপাশি থাকবেন কর্মক্ষম। ফিজিওথেরাপিতে সাধারণতঃ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রোমেডিকেল যন্ত্রপাতি যেমনঃ সর্টওয়েভ ডায়ার্থামমি, আলট্রাসাউন্ড থেরাপি, ইন্টারফেরেনশিয়াল থেরাপি, ইনফারেড রেডিয়েষন, ট্রান্স কিউটেনিয়াস ইলেকট্রিক নার্ভ ইস্টিমুলেটর, ইলেকট্রিক নার্ভ ও মাসেল ইষ্ট্রিমুলেটর, ওয়াক্সবাথ থেরাপি, অটো ও মেনুয়াল ট্রাকশন, হাইড্রোথেরাপি, লেজার থেরাপি ও চিকিৎসক বিভিন্ন কৌশগত ব্যয়াম করিয়ে থাকেন।
যেহেতু ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসকের কলা কৌশল নির্ভর তাই দেখে শুনে ভালো ফিজিওথেরাপি সেন্টারে চিকিৎসা ও পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিচের পরামর্শগুলো ঠিকমতো মেনে চললে বাতের ব্যথা থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকা সম্ভবঃ
১.ব্যথা বেশি হলে ৭দিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিবেন।
২.নিয়মিত ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিবেন।
৩.ব্যথার জায়গায় গরম/ঠাণ্ডা স্যাক দিবেন ১০-১৫ মিনিট।
৪.বিছানায় শোয়া ও উঠার সময় যেকোনো একদিকে কাত হয়ে হাতের উপর ভর দিয়ে শোবেন ও উঠবেন।
৫.মেরুদণ্ড ও ঘাড় নীচু করে কোনো কাজ করবেন না।
৬.নীচু জিনিস যেমন- পিড়া, মোড়া বা ফ্লোরে না বসে চেয়ারে পিঠ সাপোর্ট দিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসবেন।
৭.ফোম ও জাজিমে না শোয়ে উচু শক্ত সমান বিছানায় শোবেন।
৮.মাথায় বা হাতে ভারী ওজন/ বোঝা বহন নিষেধ।
৯.দাঁড়িয়ে বা চেয়ারে বসে রান্না করবেন।
১০.ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের নির্দেশমত দেখানো ব্যায়াম নিয়মিত করবেন, ব্যথা বেড়ে গেলে ব্যায়াম বন্ধ রাখবেন।
১১.শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন, পেট ভরে খাওয়া নিষেধ, অল্প অল্প করে বার বার খাবেন।
১২.কোনো প্রকার মালিশ করা নিষেধ।
১৩.দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে বা দাড়িয়ে থাকবেন না, ১ ঘণ্টা পর পর অবস্থান বদলাবেন।
১৪.শোবার সময় একটি পাতলা নরম বালিশ ব্যবহার করবেন।
১৫.হাই হিল যুক্ত জুতা ব্যবহার করবেন না, নরম জুতা ব্যবহার করবেন।
১৬.ব্যথা তীব্র হলে উঁচু কমোডে বসে টয়লেট করবেন।
১৭.চলাফেরায় ঝুকিপূর্ণ যানবাহন ও রাস্তা এড়িয়ে চলবেন ও সামনের বা মাঝামাঝি আসনে বসবেন।
ব্যথা কমে গেলে নিয়মিত সমতল জায়গায় কমপক্ষে ১ ঘণ্টা হাটুন।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি