আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধে মিয়ানমারকে কড়া বার্তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির নোবেল বিজয়ী ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিকে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধ করে সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে বলেছে। শুক্রবার মার্কিন সিনেটের এক যৌথ প্রস্তাবে এ আহ্বান জানানো হয়। ডেমোক্রেট সিনেটর ডিক ডারবিন ও রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন সিনেটে যৌথভাবে প্রস্তাব পেশ করেন। ডারবিন-ম্যাককেইনের ওই প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নিন্দা জানানো হয়েছে। ওই প্রস্তাবে মানবিক বিপর্যয় বন্ধে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আদর্শের প্রতি তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মার্কিন সিনেটরদের প্রস্তাবে জঙ্গিগোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মির হামলার নিন্দা জানানো হয়। এছাড়া মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দলকে বাধা না দিয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে বলা হয়েছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয় গৃহহারা ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তা করাসহ সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলোকে আবারও কাজ শুরু করতে। মার্কিন সিনেটের প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ডেমোক্রেট সিনেটর ডিয়ান ফেইনস্টেইন, করি বুকার ও বব মেনেনডেজ রোহিঙ্গাদের নিয়ে মার্কিন সিনেটে উত্থাপিত প্রস্তাবটিতে সমর্থন দেন।
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান এড রয়েস জানিয়েছেন, গত ৫ সেপ্টেম্বর অং সান সু চিকে চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে এড রয়েস লিখেছেন, জাতিগত কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, মিয়ানমারের সব নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া আপনার সরকার ও সেনাবাহিনীর দায়িত্ব। সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক এবং সবচেয়ে নৃশংসতম ও ভয়াবহ ওই সব তৎপরতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ওই সব ঘটনায় জড়িতরা সরকার কিংবা সেনাবাহিনী- যার সঙ্গেই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচার করতে হবে। সু চিকে লেখা চিঠিতে এড রয়েস বলেন, ‘আমি আপনার সরকার ও সেনাবাহিনীকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি। রাখাইনে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবিক সহায়তা ও সাংবাদিকদের চলাফেরার সুযোগ নিশ্চিত করার অনুরোধ করছি।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন এবং এ সমস্যার সমাধানকে গুরুত্ব দিচ্ছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেন, ‘রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই উদ্বিগ্ন। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।’ তিনি বলেন, ‘রাখাইনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় অস্ত্রধারীরা রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হত্যাযজ্ঞের ফলে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।’ হিদার নোয়ার্ট বলেন, ‘আমরা আবারও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই বর্বর হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ওই বাহিনীর প্রতি আরও সহিংসতা প্রতিরোধের এবং স্থানীয় মানুষদের সুরক্ষা দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাই।’ তিনি রাখাইনসহ মিয়ানমারের সবার প্রতি পরিস্থিতি শান্ত রাখার আহ্বান জানান। আর সব সম্প্রদায়ের মানুষকে রক্ষায় মিয়ানমার সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিকে স্বাগত জানান।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গা নিয়ে আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেরও আহ্বান জানান হিদার নোয়ার্ট। তিনি আরও জানান, মিয়ানমারকে ফোন করে রাখাইনে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা ও সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ জানিয়েছে। এ সময় হিদার নোয়ার্ট জানান, নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশ কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বড় বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, অন্য যেকোনো দেশের মতোই, শরণার্থীদের বহন করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরিস্থিতি।’
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে মিয়ানমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স। রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে, এটি এমন একটি বিষয় যা আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাননি স্যান্ডার্স। উল্লেখ্য, মিয়ানমার বাহিনীর অবরোধের মুখে গত ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গা যোদ্ধারা অন্তত ২৫টি পুলিশ স্টেশনে হামলা ও একটি সেনাক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। এতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপর রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। একের পর এক রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অভিযানে হেলিকপ্টার গানশিপেরও ব্যাপক ব্যবহার করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সীমান্তে পুঁতে রাখায় হয় স্থলমাইন।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, কুপিয়ে হত্যা, নারীদের গণর্ষণের অভিযোগ উঠে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি বয়োবৃদ্ধ নারী এবং শিশুরাও। প্রাণ বাঁচাতে স্রোতের বেগে তার বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। জেনেভায় সংবাদ সম্মেলন করে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র ভিভিয়ান জানান, দেশটির সেনাবাহিনী মিয়ানমারের রাখাইনে কমপক্ষে এক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। জাতিগত নিধনযজ্ঞের মুখে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি