বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং সে ঘটনায় মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসির খবর প্রকাশিত হয়েছে সোমবারের পত্রিকায়। খবরে বলা হয়েছে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে তাদের পরিচিত দুই যুবক জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে গত ২৮ মার্চ রাতে রাজধানীর বনানীর একটি হোটেলে আটকে রেখে রাতভর ধর্ষণ করে। দুর্বৃত্তরা দুই বান্ধবীকে হোটেলে একটি কক্ষে আটকে রেখে জোরপূর্বক মদপান করায় এবং সারারাত উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। অভিযুক্তরা হলো-সাদাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সালমান সাকিফ, সাফাতের গাড়ি চালক বিল্লাল এবং দেহরক্ষী। এরা সবাই ধণাঢ্য পরিবারের সন্তান বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, ধর্ষিতা দুই ছাত্রী বনানী থানায় মামলা করতে গেলে তাদের মামলা নেয়া হয়নি। দুই দিন নানা টালবাহানা করে গত শনিবার রাতে মামলা নেয় পুলিশ। আর এরই ফাঁকে অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিতে সক্ষম হয়। এদিকে গত শনিবার ধর্ষিতা দুই ছাত্রীর শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রিপোর্ট পেতে ১৫-২০ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল বোর্ডের প্রধান।
এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, পুলিশ যদি সাথে সাথে মামলা গ্রহণ করে অভিযুক্তদের গ্রেফতারে অভিযান চালাতো তাহলে সহজেই তাদেরকে ধরা যেত। তারা গা ঢাকা দিতে পারতো না। মামলা গ্রহণে টালবাহানা অভিযুক্তদের সরে পড়ার সুযোগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে- এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টেই বলা হয়েছে, ঘটনা আমলে নেয়া ও মামলা গ্রহণের ব্যাপারে পুলিশের চরম গাফলতি ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। আসামীরা ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হওয়ায় পুলিশ তাদেরকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে- এ অভিমত সচেতন ব্যক্তিদের।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক একটি পত্রিকাকে বলেছেন, এ ধরনের স্পর্শকাতর অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। অভিযুক্তদের সন্দেহভাজন হিসেবে তখনই জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। এ ক্ষত্রে অভিযোগ প্রমানিত হলে তাদেরকে গ্রেফতার করা যেত। তাহলে আসামীরা পালিয়ে যেতে পারতো না। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে মামলার আগেই পুলিশ আসামী ধরে ফেলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা জানার পরও পুলিশের চরম গাফলতি ও উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে।
ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক সন্দেহ নেই। ধর্ষণসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধের ক্রমবিস্তার এবং তা মহামারীর আকার ধারণ করার পেছনে যে পুলিশ তথা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা উদাসীনতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে আশ্রয় প্রশ্রয় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে, তা এখন সর্বজন বিদিত। বনানীর ঘটনায় তা আবারও প্রমানিত হলো। এমন একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ পাবার পরও উক্ত থানার পুলিশের নির্বিকার থাকাটা রহস্যজনক। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ধর্ষক তথা অপরাধীদের বাঁচানোর জন্য কূটকৌশল অবলম্বন করেছে- এমন সন্দেহকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। শুধু বনানীর ঘটনায়ই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রেও অনেক সময় পুলিশকে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও পুলিশ পালন করে অপরাধীদের সহায়কের ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে বছরখানেক আগে মতিঝিলের ঘরোয়া রেষ্টুরেন্টের শিশু কর্মচারি লিটন হত্যার কথা উল্লেখ করা যায়। রেষ্টুরেন্টটির মালিক শিশুটিকে গুলি করে হত্যার পরও আজ পর্যন্ত পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আজো সে রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন তাকে গ্রেফতার করা গেল না সে ব্যাখ্যাও আজ অবধি পাওয়া যায়নি।
আলোচ্য ঘটনার ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটার আশঙ্কা করছেন অনেকে। অভিযুক্তরা ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান হওয়ায় পুলিশের নাগালের বাইরে থেকে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। সেক্ষেত্রে ‘ আসামীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা’ বলেই পুলিশ তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারে। আর প্রতিনিয়ত সংঘটিত ঘটনাবলীর তলায় চাপা পড়ে যেতে পারে দুই ছাত্রীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারানোর করুণ কাহিনী। অন্যদিকে অপরাধ করেও সমাজে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াবে সাদমান, সাফাত আর নাঈমরা।
‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ কথাটা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। বলা হয় আইনের শাসনের কথাও। কিন্তু দুটোই এখন এদেশে সোনার হরিণে পরিনত হয়েছে। দুষ্টের দমনের পরিবর্তে চলছে তাদেরকে আদর যতেœ লালন পালন, আর আইনের শাসনের পরিবর্তে আসন গেড়ে বসেছে অপশাসন। যে জন্য সাগর-রুনির হত্যাকারী, সোহাগী জাহন তনুর ধর্ষক ও খুনি বছরের পর বছর পার হলেও চিহ্নিত হয়না, ধরা পড়ে না। এ অবস্থা যতদিন থাকবে, সমাজে অপরাধীদের রাজত্বও চলবে দোর্দন্ড প্রতাপে।
দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী ধর্ষণ ঘটনার শেষ পরিনতি কী হবে তা এখনই বলা যাবেনা। তবে, এ ঘটার হোতারা আদৌ আইনের আওতায় আসবে কীনা তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ, শুরুতেই পুলিশ যে মনোভাব দেখিয়েছে, তাতে পরবর্তিতে ঘটনার মোড় কোন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয় সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। শেষ পর্যন্ত যদি দুই ছাত্রীকে ‘ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ’ করার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয় তাহলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।