২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৬:১০

সারাদেশে চিকুনগুনিয়া ডেঙ্গুর সঙ্গে বাড়ছে ডায়রিয়া

স্বাস্থ্য ডেস্ক:

ঘরে ঘরে চিকুনগুনিয়ার আতঙ্ক। রাজধানীতে আছে ডেঙ্গুর প্রকোপও। সঙ্গে ডায়রিয়াও ছড়িয়ে পড়েছে। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক হয়ে দেখা দেয় মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ চিকুনগুনিয়া জ্বর। একপর্যায়ে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। একই সঙ্গে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপও। আর বর্ষায় ডায়রিয়ার প্রকোপ একটি নিয়মিত ঘটনা। এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় এ বছর আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় দুই লাখ মানুষ। ডায়রিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় ৫৭৫ জন আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ছয়জন। চলতি মাস থেকে শুরু করে টানা তিন মাস এই তিন রোগের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। ওই ঝুঁকি মোকাবিলায় তৎপরতাও শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, আগামী তিন মাস পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু আর ডায়রিয়ার বিস্তার থাকতে পারে। তাই আমরা এই তিন রোগের ব্যাপারে সতর্কতামূলক নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রস্তুতি রয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে যতই এডিস মশা এবং অনিরাপদ পানির ব্যাপারে সচেতনতা বাড়বে, এই তিন রোগের ঝুঁকি ততই কমবে। ডায়রিয়ার ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে বন্যাপ্রবণ এলাকায় মেডিকেল টিম কাজে নামিয়েছি। পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি ও খাবার স্যালাইন সরবরাহ করেছি। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আমরা শিগগিরই প্রায় এক লাখ কলেরা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছি। তাও প্রয়োজন মতো ঢাকা বা বেশি ডায়রিয়াপ্রবণ এলাকায় সরবরাহের জন্য প্রস্তুতি রেখেছি।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে চার হাজার ১১০ জন। এদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ডায়রিয়ার রোগী ছিল ৫৭৪ জন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় কেবল রাজধানীর আন্তর্জাতিক উদারাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ বা আইসিডিডিআরবি হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছে ২০২ জন। এ বছর ১লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৮৯ হাজার ৫৮৭ জন। এরমধ্যে রাজধানীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছে ৮৬ হাজার ২২ জন। দেশে এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ছয়জন। এরমধ্যে রাঙ্গামাটিতে দুজন, ঠাকুরগাঁয়ে দুজন, মাগুরা ও সিলেটে একজন করে মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫১৬ জন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জুনেই ভর্তি হয়েছেন ১৮১ জন। এদের অনেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সূত্রমতে, চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৫শ’র বেশি। তবে বেসরকারি সূত্রমতে, ওই সংখ্যা লাখের ওপরে হতে পারে। আবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে যাওয়া কেউ কেউ একাধারে চিকুনগুনিয়ায়ও আক্রান্ত বলে ওইসব হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়ার রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীও আসছে তার কাছে। এবার বর্ষা মৌসুমে একাধারে চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি। বরাবরই বর্ষার সময় দেশে ডায়রিয়া লেগে থাকে। তবে এবার ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া আগামী তিন মাসের বেশি সময় থাকতে পারে। তাই এবার মানুষকে অবশ্যই অনেক বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, তবে মনে রাখতে হবে কেবল চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুই নয়, প্রস্রাবের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড থেকেও জ্বর হতে পারে। ফলে জ্বরের রোগী হলেই যেন চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া না হয়। অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারেও সতর্ক থাকা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ডেঙ্গু অথবা চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্তদের আমরা হাসপাতালে ভর্তি করতে চাই না। কারণ, এটা ঘরে রেখেই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে এখনকার মানুষ বেশ সচেতন। জ্বরের রোগী ভর্তি করলে আমরা অন্য গুরুতর রোগীর চিকিৎসা করতে পারবো না। ডেঙ্গু অথবা চিকুনগুনিয়ার প্রায় একই ধরনের চিকিৎসা। কেবল প্যারাসিটামল ছাড়া কোনো ব্যথানাশক অথবা স্টেরয়েড দেয়া যাবে না রোগীকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু অথবা চিকুনগুনিয়া জ্বরই হোক তা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশার বিস্তার কমাতে হবে। এডিস মশার দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবুপিকপকটাসের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে, আবার মানুষ থেকে মশার মাধ্যমে আসছে। পরে মশা থেকে আবার মানুষকে সংক্রমিত করছে। একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে বারবার ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও একবার চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে আর কখনো ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হবে না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। অন্যান্য মশা ময়লা নোংরা পানিতে বংশবিস্তার করলেও এডিস মশা এর ব্যতিক্রম। পরিষ্কার পানিতে এরা ডিম ছাড়ে। সহজে চোখে পড়ে না এমন জায়গার পরিষ্কার পানিতে এসব মশা ডিম ছাড়ে। ফলে শহরে, বিশেষ করে অভিজাত এলাকায় এডিস মশা বেশি দেখা যায়।
ডেঙ্গুর চিকিৎসার ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ডেঙ্গুজ্বর হলে প্রচুর পানি পান করতে হবে ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর বাড়লে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ অথবা আরো বেশি জ্বর হলে তা কমিয়ে রাখার জন্য সাপোজিটরি ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতে রেখেও হতে পারে। বেশি দুর্বল বা শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়লে, নাক ও দাঁত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকলে হাসপাতালে নেয়াই ভালো। ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত ১০ দিনের মধ্যে সেরে যায়। কিন্তু দুর্বলতা আরো কিছু দিন থেকে যেতে পারে। ভাইরাসজনিত জ্বর বলে এর কোনো চিকিৎসা নেই। কেবল লক্ষণ বুঝেই চিকিৎসা দিতে হবে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বিষয়ে আগাম সতর্কতা এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি উল্লেখ করে আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার বলেছেন, এ বছর হঠাৎ ভারিবর্ষণ, বর্ষা মৌসুমে মশার বংশবিস্তারের কারণে মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০৬০ জন, মারা গেছেন ১৪ জন। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬২ জন, মারা গেছেন ছয়জন। ২০১৪ সালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৩ জন। কেউ মারে যাননি। ২০১৩ সালে ১৪৭৮ জন, ২০১২ সালে ১২৮৬ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ

প্রকাশ :জুলাই ৮, ২০১৭ ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ