২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৫১

রাজনীতির হাটে যখন জনগণ পণ্য

রাজু আহমেদ
দেশজুড়ে রাজনীতির হাট সরাগরম হয়েছে। বিক্রেতা মাত্র জনাকয়েক আর পণ্য দেশের কোটি কোটি মানুষ ! নির্বাচনের সময় ঘনাচ্ছে বলে পণ্যের দামেও কিছুটা উঠতি ভাব। ক্ষমতা ও ক্ষমতার বাইরের ক্ষমতাবনরা এবার নির্বাচনী পণ্যকে ঝেড়ে-ফুঁকে উজ্জ্বলতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। যদিও বারবার বলা হয়, জনগণের মদদ নিয়েই একেকদল ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করে কিন্তু এর ভেতরে-বাইরে যে রঙ্গরসের চতুর্মূখী খেলা চলে তা পণ্যেরা বোঝে বটে, কিন্তু আহা-উঁহু করার শক্তি ও স্বাধীনতা বেশ পূর্বেই খুইয়ে এখন তারা সতীত্ব হারানো সাধুর ভূমিকায়। যে দলই যখন কোনভাবে ক্ষমতায় গিয়েছে তখন ক্ষমতার সবটুকু তারা মালিকানা ভেবে দখলে নিয়ে সা¤্রাজ্য সাজাতে কৌশল-অপকৌশলের সবটুকু বিনিয়োগ করেছে। সাধারণ জনগণের মতামতের যে একটু ভূমিকা আছে তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়। জনগণের মত তখন অবিক্রীত পণ্যের থেকে বেশি উপেক্ষিত-লাঞ্ছিত হয়।
অতিসম্প্রতি বৃটেনে অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। সেখানে প্রধান দু’দলের মধ্যে শুধু ভোটের লড়াই নয় বরং কথার লড়াই হয়েছে তুমুল, জমেছেও বটে। তবে কেউ শালীনতার সীমা ত্যাগ করেনি একটুকুনও।  তাদের ভাবখানা খেলোয়াড়সূলভ ছিল। খেলার মধ্যে যত দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতাই হোক জয়-পরাজয় নির্ধারিত হওয়ার পর পরাজিত দল যেমন জয়ী দলকে অভিনন্দন জানায়, তেমন জয়ী দলও পরাজিত দলকে বুকে টেনে নেয়, জয়ী হতে প্রেরণা দেয়া। বৃটেনের রাজনীতির যুদ্ধেও তেমনি খেলোয়াড়সূলভ মনোভাব বিরাজিত। বৃটেনের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষায় জয়ী কনজারভেটিভের চেয়ে পরাজিত লেবারের ভূমিকা কোনভাবেই কম নয়। এছাড়াও ৬৫০ আসনের বিশাল নির্বাচনে পরাজিত দলগুলোর কোন সদস্যই একটুখানি ভোট কারচুপির অভিযোগ আনেনি কিংবা কোথাও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্গিত হয়েছে এমন সংবাদও গনমাধ্যম দিতে পারেনি।
অথচ আমাদের প্রিয় স্বদেশ ? এখানে সামান্য ইউপি নির্বাচন হলেও সরকার ও বিরোধীদলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ আসে। সর্বশেষ কবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছিল তার খোঁজ পেতে এ প্রজন্মকে ইতিহাসের পাতা হাতড়াতে হবে। রাজনীতি যদি কেবল জনসেবা ও দেশসেবার উদ্দেশ্যে হতো তবে এমন নীতি অসংলঙ্গ আচরণের সাক্ষী হওয়ার মত দুর্ভাগ্য এ জাতিকে বরণ করতে হতনা। এ ভূমিতে রাজনীতি এখন ব্যবসায়ের সর্বোচ্চ স্থান নিয়েছে। রাজনীতির হর্তাকর্তাদের বেশিরভাগ নামে-বেনামে ব্যবসায়ের হাট খুলেছে। তাদের কাছে চাকরি পাওয়া যায়, পয়সা-কড়ি মেলে। জনগণকে তারা বেশ ভালোভাবেই পণ্যের ভূমিকায় ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনে যদি রাষ্ট্রের নাগরিকদের মতামত দেয়ার স্বচ্ছ ভূমিকা না থাকে তবে সে রাষ্ট্রের নাগরিকদের পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া আর কি ভূমিকা থাকতে পারে ? গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যদি জনমতের বাস্তব প্রয়োগ-প্রতিফলন না ঘটে তবে গণতান্ত্রিক মুখোশ পড়ে লাভ কি ? গণতন্ত্রের বাইরেও তো ক্ষমতায় থাকার আরও বহু পথ-পদ্ধতি আছে।
নির্বাচন ! এটার আয়োজন বোধহয় না করলেই ভালো !!  সার্বিক স্বচ্ছতা যদি নিশ্চিত করা না যায় তবে অহেতুক রাষ্ট্রাভ্যন্তরে পারস্পারিক শত্রুতা-বিদ্বেষ উসকে দিয়ে এবং দশ কোটির অধিক ভোটারের নাগরিক অধিকার নিয়ে খেলার আয়োজন করে লাভ কি ? ভারতের মত একটি বিশাল আয়তন ও জনসংখ্যার দেশে কয়েক ধাপে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনে একজন মানুষ নিহত তো দূরের কথা হতাহত হওয়ার খবর পর্যন্ত পাওয়া যায়না অথচ আমাদের দেশে ? সাধারণ  একটি ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলার নির্বাচনে হালি হালি লোক নিহত হয়। এটাই কি রাজনীতির শিক্ষা ?
ইতিহাসের জঘন্যতম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো আমেরিকায়। অনাকাঙ্খিতভাবে প্রেসিডিন্টে হলেন ট্রাম্প। অথচ নির্বাচনকালীন সময়ে ট্রাম্প তার প্রতিপক্ষ প্রার্থীর সম্পর্কে যাসব বলেছে তার সাথে বর্তমান ট্রাম্পের কোন মিল কি কেউ খুঁজে পেতে পারবে ? নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প অসম্মানের সাথে হিলারির নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি। অথচ আমাদের দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনের সর্বোচ্চ মহলের ক্ষমতাধরেরা পরস্পরকে যেভাবে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন, কটূক্তি করেন তা দেশে এবং দেশের বাইরে নজীরবিহিনী। ভাগ্যসহায় কেননা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গছাড়া বিদেশীদের কেউ বাংলা তেমন বোঝেনা নয়ত রাজনৈতিক অঙ্গনের তুখোড় নেতাদের এমন বাক্যচয়ন শুনে তারা লজ্জিত হতেন। কেননা রাজনীতির ইথিকসের কোন ধারাতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের আগ্রাসী প্রকাশকে মেলানো যায়না।
বিশ্বের তাবৎ জাতি উচ্চারণ ও আচারণে যখন আলোর পথের যাত্রী তখন বোধহয় কেবল আমরাই কিছুটা অন্ধকারে হাঁটছি। আমাদের গর্বিত তিন মেয়ে বৃটেনের কমন্সসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক ইমেজের সাথে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কিছু নেতা-কর্তার ভাব মেলাতে গেলে লজ্জিত হতে হয়। এ মাটির সন্তান হয়ে তারা বৃটেনে স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত হতে পারলে এখানে মানুষগুলো কেন স্বচ্ছভাবে নির্বাচিত হয়ে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সাহস পোষণ করেন না ? অনৈতিকতা ও অস্পষ্টতা ছাড়া কোন কিছু অর্জন করতেই বোধহয় আমরা দিনে দিনে ভুলে যাচ্ছি। ক্রমশ অসহিষ্ণুতার যে স্ফূলিঙ্গ আমাদের থেকে বহিমূর্খী হচ্ছে তা মোটেও আশার প্রদীপ দেখায় না। কোন সন্দেহ নাই, অর্থে-উন্নয়নে আমরা খানিকটা উন্নত হয়েছি, কিন্তু নৈতিকতার মানদন্ডে, অন্যের অধিকার নিশ্চিত করতে, নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে, দেশের কল্যাণ-মঙ্গল অটুট রাখতে এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা কি দল-মতের উর্ধ্বে সত্য গ্রহণকে প্রাধাণ্য দিতে পেরেছি ? নিকট অতীতের ২০১৪ পারিনি, আসছে আগামীর ২০১৮ এর শেষে পারবো কি ?
রাজু আহমেদ। কলামিষ্ট।

প্রকাশ :জুন ১৯, ২০১৭ ৪:০৬ অপরাহ্ণ