৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ইং | ২০শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ৭:০২

গাফিলতি ও ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু

নড়াইল প্রতিনিধি:
নড়াইলের লোহাগড়ায় সিজারিয়ান অপারেশনের প্রায় আড়াইঘন্টা পর হাসপাতাল কাম ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও ভুল চিকিৎসায় তৃষ্ণা রাণী বিশ্বাস (৩০) নামে দুই সন্তানের জননীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে জয়পুরস্থ বিসমিল্লাহ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগণষ্টিক সেন্টারে সিজারিয়ান অপারেশনের পর ওই প্রসূতির মৃত্যু হয়। লাইসেন্সবিহীন ওই ক্লিনিক কাম হাসপাতালটি প্রায় দুই বছর যাবৎ প্রশাসনের নাকের ডগায় অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল সার্জন অফিস থেকে ওই হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা অদৃশ্য ইশারায় আমলে নেয়নি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ। প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় অবশেষে ১লাখ ২৫ হাজার টাকায়  ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে এবং ২৫ হাজার টাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ক্ষমতাশালীরা চাপে ফেলে বিষয়টির আপোষরফা করেছে বলে সূত্র জানায়। ফলে পোষ্ট মর্টেম ছাড়াই লাশ ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।

অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জয়পুর গ্রামের সুব্রত বিশ্বাস বৃহস্পতিবার রাতে তার স্ত্রী তৃষ্ণা রাণী বিশ্বাসকে সিজারিয়ান অপারেশন করানোর জন্য জয়পুরস্থ বিসমিল্লাহ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগণষ্টিক সেন্টারে সুস্থ অবস্থায় নিয়ে আসেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে কথিত সার্জন ডাক্তার তাজরুল ইসলাম তাজ ও লোহাগড়া হাসপাতালের ডাক্তার (এনেসথেসিয়া) সুব্রত কুমার এর তত্বাবধানে তৃষ্ণা রাণী বিশ্বাস এর সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। ফুটফুটে কণ্যা সন্তানের জন্মদেন তৃষ্ণা। কিন্তু অপারেশনের প্রায় আড়াইঘন্টা পর রাত ১১টার দিকে তৃষ্ণা হঠাৎ মারাত্বক অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগীর বমি ও খিচুনি হতে থাকায়  ক্লিনিকের মালিক এবং ডাক্তার তাজরুল ইসলাম তাজ ও ডাক্তার সুব্রত কুমার রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখে আরো কয়েকজন ডাক্তারকে ওই ক্লিনিকে দ্রুত নিয়ে আসেন এবং চিকিৎসা দেন। কিন্তু রোগীর মৃত্যু হয়। ডাক্তাররা রোগীর মৃত্যুর সাথে সাথেই ক্লিনিক থেকে চলে যান। রোগীর মৃত্যু হলেও প্রায় ২ ঘন্টা মৃত্যুর খবর গোপন রাখা হয় এবং রোগীকে দ্রুত ক্লিনিক কাম হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা হলে প্রসূতির লোকজন তখন প্রসূতির  মৃত্যুর বিষয়টি টের পান। প্রসূতির আত্মীয় স্বজন খবর পেয়ে ক্লিনিকে এসে জড়ো হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। খবর পেয়ে লোহাগড়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে যেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তৃষ্ণার নবজাতক কণ্যা শিশু ছাড়াও প্রণব বিশ্বাস নামে ৫ বছরের পুত্র সন্তান রয়েছে।

প্রসূতি তৃষ্ণার মা শংকরী রানী বিশ্বাস ও মামি শ্বাশুড়ি গিতা অভিযোগ করেন, সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় তৃষ্ণাকে ক্লিনিকে আনা হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসা ও গাফিলতিতে তৃষ্ণার মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তার তাজরুল ইসলাম তাজ ফোনে জানান, অপারেশনের পরে  রোগীর বমি ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। খাদ্যনালী ও শ্বাসনালী এক সাথে থাকে। সম্ভাবত বমি শ্বাসনালীতে ঢুকে গিয়ে রোগীর মৃত্য হয়েছে। ডাঃ সুব্রত কুমার বলেন, আগেই রোগীর শ্বাস কষ্টের সমস্যা ছিল। অপারেশন করার পর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় বমি হয় এবং বমি শ্বাসনালীতে আটকে প্রসূতির মৃত্য হয়। প্রসূতির পরিবারের অভিযোগ, তৃষ্ণার শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই তড়িঘড়ি করে অপারেশন করাতেই তৃষ্ণার মৃত্যু হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ডাঃ সুব্রত কুমার লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ কমপ্লেক্রের ডাক্তার। তিনি অফিস চলাকালীন সময়ে সরকারি হাসপাতালের চেম্বার বা জরুরী বিভাগের দায়িত্ব ফেলে রেখে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে অপারেশন করে থাকেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ও সূত্র জানায়, রোগীর শারীরিক অবস্থা  না দেখেই টাকার লোভে দ্রুত তৃষ্ণার অপারেশন করা হয়েছে। লোহাগড়ার ক্লিনিকগুলোতে ডাক্তার এক রাতে ৮/১০ টি সিজারিয়ান অপারেশন করেন। রোগীর ভালমন্দ দেখার সময় কোথায় ? অপারেশন টেবিলে নিয়ে কাটলেইতো টাকা ? যে কারনে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। বৃহস্পতিবার রাতে আরো ৪/৫টি সিজারিয়ান অপারেশনের চাপ ছিল বলে ডাক্তার তাজরুল ইসলাম তাজ স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, আমি বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত। পিজি হাসপাতালে ইউরোলজীতে এমএস করছি। আপনি সার্জন কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ট্রেনিং করা আছে। অভিজ্ঞতার আলোকে অপারেশন করছি। অভিযোগ রয়েছে, সিজারিয়ান অপারেশন করার সরকারি অনুমতি না থাকলেও তিনি প্রতি সপ্তাহে অন্তত ২০/২৫ টি সিজারিয়ান অপারেশন করে থাকেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, ডাক্তার তাজ খুব অল্প বয়সে টাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখার সময় কোথায়? তড়িঘড়ি করে বিভিন্ন ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করতে পারলেই হলো ? টাকা তো আসে।

ঘটনা জানতে চাইলে ক্লিনিক কাম হাসপাতালের পরিচালক মোঃ ইখলাছুর রহমান বলেন, পরে কথা বলবো। লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কেউ আমাদের কাছে কোন অভিযোগ দেয়নি। তবে খবর শুনে টহল পুলিশ পাঠিয়েছিলাম। এ বিষয়ে জানতে নড়াইলের সিভিল সার্জন ডাঃ আমীন আহম্মেদের ফোনে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমি এখন গোরস্থানে (যে কারনে বক্তব্য শোনা সম্ভব হয়নি)। সূত্র জানায়, অবশেষে ১লাখ ২৫ হাজার টাকায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারকে এবং ২৫ হাজার টাকায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ক্ষমতাশালীরা চাপে ফেলে বিষয়টির আপোষরফা করেছেন।

দৈনিক দেশজনতা /এমএম

প্রকাশ :জুন ১৭, ২০১৭ ৪:৫২ অপরাহ্ণ