বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের মনেও এখন করোনোভাইরাসের আতঙ্ক। যতটুকু সম্ভব সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করছেন সবাই। অনেকেই সুরক্ষা-কবজ হিসেবে ব্যবহার করছেন মাস্ক।
এদিকে হঠাৎ মাস্কের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা মাস্কের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তৈরি হয়েছে সংকট। কিছুদিন আগেও যে মাস্ক মাত্র ২০ টাকায় পাওয়া যেত, এখন তা ৫০-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন মাস্ক বিক্রেতার ছবি ভাইরাল হয়েছে। বিক্রেতা চাহিদা এবং অধিক লাভের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বল্প মূল্যে মাস্ক বিক্রি করছেন। তার এই উদ্যোগ নেটিজেনদের বাহবা কুড়াচ্ছে।
বিক্রেতার নাম এনামুল হক গাজী। গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের সামনে তিনি তৈরি পোশাক বিক্রি করেন। এটাই তার মূল পেশা। কিন্তু হঠাৎ করে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত তিনজনের সন্ধান পাওয়া গেলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। অনেকেই সুরক্ষা পেতে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনতে শুরু করেন। এনামুলও তখন মাস্কের ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দুদিন ১৮ টাকায় মাস্ক কিনে ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করেছেন। তৃতীয় দিন ৪০ টাকায় কিনে বিক্রি করেছেন ৪৫ টাকা। কিন্তু বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মাস্কের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৫৫ টাকা।
অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে প্রথম থেকেই ৬০ থেকে ১৫০ টাকা দরে মাস্ক বিক্রি করলেও অতিরিক্ত লাভের আশা করেননি এনামুল। উল্টো দাম কমিয়ে দিয়েছেন। ৫৫ টাকার মাস্ক বিক্রি করছেন ২০ টাকায়।
এনামুল বলেন, ‘লাভ তো সারা বছরই করি। যখন মাস্ক হাতে নিয়ে দাম বেশি শুনে কাস্টমার রেখে চলে যায়, টাকার কারণে কিনতে পারে না, তখন খারাপ লাগে। এজন্য লাভের যে টাকা ছিল তা থেকে বাসা ভাড়া দিয়ে বাকি টাকায় ৩০০ মাস্ক কিনেছি ৫৫ টাকা রেটে। সেগুলো বিক্রি করছি ২০ টাকা করে। আসলে আমরা একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একটু ছাড় দিয়ে যদি মানুষের উপকার করা যায় সে লাভও তো কম নয়। তাই আমাদের মতো নিম্নবিত্ত ব্যবসায়ীর পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব করার চেষ্টা করছি।’
এনামুল গাজীর গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানার শিধল কুড়ার চরে। বাবা মা আর চার ভাইয়ের সংসার। ভাইদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। সবাই ঢাকা থাকেন। বড় ভাই সামান্য বেতনে চাকরি করেন। তিনিসহ আরেক ভাই ফুটপাতে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করেন। আর সবার ছোট ভাই পড়েন নটরডেম কলেজে ১ম বর্ষে। ঢাকায় সবাই মিলে বাড্ডায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
অধিকাংশ ব্যবসায়ী সুযোগ পেয়ে কত লাভ করা যায়- যখন এমন ফন্দি আঁটছেন, তখন উল্টো স্রোতে হাঁটছেন এনামুল। যে কারণে তার মাস্ক বিক্রির দৃশ্য ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই এনামুলের মানসিকতার প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। লুবজানা আফরিন তার ফেইসবুক পেইজে এনামুলের মাস্ক বিক্রির ছবিসহ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার আইডি থেকেই ছবিটি ৪ হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে। তিনি লিখেছেন: ‘একজন ফুটপাতের হকার প্রতিটি মাস্ক ২০ টাকা দামে বিক্রি করছে। শর্ত হচ্ছে একজন ক্রেতা শুধু একটি মাস্ক কিনতে পারবে। যদি সংকটকালে মানবিকতা এভাবে সাড়া দেয়, তাহলে আমি মনে করি মানবতা বিজয়লাভ করবে।’
এনামুলের ছোট ভাই সাব্বির আহমেদ ফেইসবুকে লিখেছেন: ‘আমি একজন ফুটপাতের হকারের ভাই হিসেবে গর্বিত। হ্যাঁ, ২০ টাকায় মাস্ক বিক্রেতাটি আমার বড় ভাই। আমরা বিশ্বাস করি, সকল মানুষই কোন না কোন মায়ের সন্তান।’
শামীম রহমান লিখেছেন: ‘সব থেকে ভালো লাগার ব্যাপার ছিলো, ২০ টাকায় মাস্ক বিক্রি করা। এবং একজনের কাছে একটি মাস্ক বিক্রি করা। মানুষের দ্বারা যদি করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, তবে এই মানুষগুলোই পারবে।’
ফুটপাতে ব্যবসা করে যে আয় হয়, তা দিয়েই এনামুলের সংসার খরচ চলে যায়। ফলে অতিরিক্ত লাভের আশা তিনি করেন না। এনামুল বলেন, ‘মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা আমি কোনোদিন করিনি। দোয়া করবেন, কখনও যেন করতে না হয়।’