ভারত থেকে আসা এক তরুণ অসুস্থবোধ করায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তাকে ‘করোনা রোগী’ হিসেবে প্রচার করেছেন বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরী। বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সোয়া বারোটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিজের ফেসবুক পেজে ওই তরুণের পাসপোর্ট ও ছবি প্রকাশ করে তিনি লেখেন ‘করোনা রোগী শনাক্ত।’ এর নিচে তরুণের পুরো পরিচয়ও তুলে দেন তিনি। তবে চিকিৎসকরা তাকে ‘করোনা রোগী’ হিসেবে শনাক্ত না করায় সেই পোস্ট মুছে (ডিলিট) দিয়ে আবারও আরেকটি পোস্টে লেখেন ‘শনাক্ত নয়’। সেখানেও সচেতনভাবে ভারত থেকে আসা ওই তরুণের নাম, পিতার নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং ছবি পোস্ট করেছেন বেলাল চৌধুরী।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করার কৃতিত্ব পাওয়ার আশায় ব্যক্তির গোপনীয়তা ও রাষ্ট্রের নির্দেশনা ভঙ্গ করেই এ কাজ করেছেন তিনি।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে—‘করোনা ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে যারা হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য ভর্তি হচ্ছেন এবং তাদেরকে শনাক্ত করা যায়—এমন কিছু প্রকাশ করা যাবে না।’ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, ‘প্রচার-প্রচারণার কারণে কেউ যেন সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন না হয়, সেদিকে অবশ্যই সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি পোস্ট করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিশনার বেলাল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অনেক সময় অনেক ছবি দিয়েছি ফেসবুকে। এই ছবিটিও অ্যাওয়ার করার জন্য দিয়েছি।’ আর যদি ওই তরুণ সত্যিই করোনায় আক্রান্ত হতো, তাহলে সেটা আমাদের জন্য ক্রেডিট হতো বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া বারোটায় বেলাল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘বেনাপোলে ভারত থেকে আসা করোনা রোগী শনাক্ত।’
‘ভারত থেকে আসা বন্ধন এক্সপ্রেস থেকে একজন করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারা রেলের নিয়মিত দায়িত্ব পালনকালে একজন বিশ্বস্ত সূত্রে গোপনে সংবাদ পায় এবং রোগীকে শনাক্ত করেন। তাৎক্ষণিক এসি উত্তম চাকমা ও আকরাম হোসেন বিষয়টি যশোর সিভিল সার্জন অফিস ও উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসকে জানান এবং সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে আনেন।’
এরপর তিনি ‘শনাক্ত’ হওয়া রোগীর নাম, তার পিতার নাম এবং বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করেন।
এরপর বেলাল চৌধুরী লিখেছেন, ‘তিনি (ওই তরুণ) চীন থেকে ভারতে আসেন। ভারতীয়রা বিষয়টি সম্ভবত বুঝতে পেরে তাকে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে তুলে দেয়। তিনিও আত্মগোপন করেছিলেন। কাস্টমস টিম চিকিৎসকদের আসা নিশ্চিত করে। বর্তমানে তিনি (তরুণ) সিভিল সার্জন টিমের হেফাজতে আছেন।’
কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরী পরের প্যারায় করোনা ভাইরাস নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস অফিসের সচেতনতার কথা লেখেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘বিস্ময়কর হলেও বেনাপোল কাস্টম হাউজে কর্মকর্তাদের তৎপরতায় এ অঞ্চলে প্রথম করোনা রোগী দেশে ঢোকার আগেই ধরা পড়ে। যে কেউ এমন রোগী দেখলে চিকিৎসক টিমকে জানান। রোগী যথার্থ পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন, ভাইরাস ছড়িয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগে। অবহেলায় উল্টোটা ঘটে।’
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তিনি ওই তরুণের ছবি, নাম-পরিচয়, পিতার নাম, পাসপোর্টের ছবি পোস্ট দেন তার পেজে। মুহূর্তের মধ্যে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
তবে এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর তিনি ওই তরুণের ছবি ও নামসহ আবারও একটি পোস্ট দেন। এবার লেখেন, ‘চিকিৎসকের পরীক্ষায় জনাব … করোনা ভাইরাসমুক্ত বলা হয়েছে। আমরা নিজেদের দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করি।’
তিনি লেখেন, ‘ভারতের রেলগার্ড মেন্যুফেস্টো দিতে গিয়ে বেনাপোল কাস্টমস টিমের রাজস্ব কর্মকর্তাকে বলেন ‘ট্রেনে ৬৫ জন যাত্রী, একজন অনুপস্থিত ও একজন করোনা রোগী আছে! তাৎক্ষণিক চেকপোস্টের ডাক্তার আজিমউদ্দিন আসেন এবং তার পাসপোর্ট দেখে তাকে সম্ভাব্য রোগী হিসেবে আলাদা করে নেন। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করেন।’
‘‘গার্ডের বক্তব্য, ডাক্তারের করোনা সন্দেহজনক যাত্রী খুঁজে পাওয়া ও যাত্রীর ভাবভঙ্গি থেকে তাকে আমাদের টিম সন্দেহবশত ‘করোনা রোগী’ বলেছে। এ বিষয়ে কোনও সংশয় তৈরি হলে আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত!’’
‘কাস্টমস চেকপোস্টে সচেতনতার জন্য আমরা গত ২৯ জানুয়ারি তারিখে করোনা সচেতনতা সেমিনার করি। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের প্রদর্শিত নির্দেশনালোকে কাস্টমস টিম দায়িত্বের অংশ হিসেবে রোগী আলাদা করে স্বাস্থ্য কর্মীদের কাছে হস্তান্তর করে।’
‘আমরা সচেতনতার জন্য পোস্ট দেই। সংশয়ের জন্য নয়। দয়া করে কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না।’ এই ছিল বেলাল চৌধুরীর দ্বিতীয় পোস্টের বক্তব্য।
এদিকে ভারত থেকে বেনাপোলে আসা তরুণকে করোনা সন্দেহে পরীক্ষা করে কোনও আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন যশোরের সিভিল সার্জন শেখ আবু শাহীন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উনাকে পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনও কিছু পাওয়া যায়নি। তাকে তার বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছে এবং ১৪ দিন বাড়িতে অবস্থানের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে যদি তার শারীরিক অসুস্থতা পরিলক্ষিত হয়, তবে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সন্দেহভাজন এই যাত্রীর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে।’
এদিকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সন্দেহভাজনদের নাম, ঠিকানা ও ছবি প্রকাশ না করার আহ্বান জানিয়েছে। বেনাপোল কাস্টমসের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কী করে ফেসবুকে এভাবে ওই তরুণের ছবি দিয়ে পরিচয় প্রকাশ করলেন, এমন প্রশ্নে আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘কোনও সরকারি কর্মকর্তা চাকরির নিয়ম অনুযায়ী এটা করতে পারেন না। কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের কাজ কী কারও পাসপোর্ট নাম্বার পাবলিককে বলে দেওয়া।’
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ‘এটা ডিলিট করে দিয়েছি’ বলে মন্তব্য করেন বেলাল চৌধুরী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘ওটা যদি শেয়ার হয়ে থাকে, তাহলে এখন আর নেই। মূল পোস্ট ডিলিট হয়ে গেছে।’ কিন্তু সেগুলোর স্ক্রিনশট তো রয়ে গেছে, জানালে তিনি বলেন, ‘‘ফেসবুকে একসঙ্গে অনেকগুলো ছবি গিয়েছে, আমি ‘ওইভাবে’ খেয়াল করিনি আসলে, আর আমি গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পুরোটা দেইনি। কেবল থানা উল্লেখ করেছি।’’
কারও পাসপোর্ট পাবলিক (প্রকাশ্যে উপস্থাপন) করতে পারেন কিনা এবং করোনা সন্দেহে যাদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাদের নাম ঠিকানা সরকার প্রকাশ না করার আহ্বান জানানোর পরেও তা করলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছিলাম গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইনভলব হয়ে তার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিক। তাকে যেন আইডেন্টিফাই করতে পারে। তাকে আমরা সন্দেহ করেছি, আমাদের টিম আতঙ্কিত হয়েছে।’
টিম আতঙ্কিত হলেই কি তার ছবি ফেসবুকে দিতে হবে, এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যদি তিনি রোগী হতেন তাহলে কিন্তু আমাদের ক্রেডিট থাকতো। যেহেতু রোগী নন, সে কারণেই এত কথা হচ্ছে।’
রোগী হলেও তার ছবি প্রকাশ করা সঙ্গত কিনা এমন প্রশ্নে বেলাল চৌধুরীর জবাব, ‘সেটা অন্য কথা, আর আমি তো অ্যাওয়ারনেসের জন্য দিয়েছি।’