অনলাইন ডেস্ক:
প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, যাদের মালিকানায় মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। প্রত্যেকে তার নিজের পক্ষ থেকে এবং নাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করবে।
টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলংকার, বসবাস ও খোরাকির প্রযোজনে আসে না এমন জমি, বসবাসের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য, অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র-পত্র কিছু সদকাতুল ফিতরের নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
কেউ যদি ঋণগ্রস্ত হয়, তাহলে সে ঋণ বাদ দিয়ে নেসাবের হিসাব করবে।
সদকাতুল ফিতরের ফযীলত
বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.)সদকাতুল ফিতরের বিধান দান করেছেন রোযাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা, কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে। যে ব্যক্তি তা (ঈদের) নামাযের আগে আদায় করবে সেটা গ্রহণযোগ্য সদকা হিসেবে পরিগণিত হবে। আর যে (ঈদের) নামাযের পর আদায় করবে সেটা সাধারণ সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৬০৯)।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ
আমাদের দেশের বহুল প্রচলিত পরিমাণ হলো, পৌনে দুই সের গম বা এর মূল্য। সব শ্রেণির সম্পদশালী এই এক প্রকারেই সদকাতুল ফিতর আদায় করেন থাকেন।
যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও ৫ গম দ্বারা সদাকাতুল ফিতর আদায় করতে চাইলে মাথাপিছু এক ‘সা’ পরিমাণ দিতে হবে। কেজির হিসাবে যা ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আধা ‘সা’ দিতে হবে। কেজির হিসাবে ১ কেজি ৬৩৫ গ্রাম। এটা ওজনের দিকে তফাত। আর মূল্যের পার্থক্য তো আছেই।
উল্লেখ্য, ‘সা’ ও অর্ধ-সা এর পরিমাপ নির্ধারনের ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক সর্বোচ্চ পরিমাণটি গ্রহন করা হয়েছে।
হাদীসে এ পাঁচটি খাদ্যের যেকোনো একটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া রয়েছে।
যারা সাধ্য পনির হিসাবে দেওয়ার তিনি তাই দেবেন। এর চেয়ে কম আয়ের লোকের খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারেন। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন তিনি আদায় করবেন গম দ্বারা।
‘অব্যশ্য কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো সৎ কাজ করে, (এবং নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেয় ) তবে তার পক্ষে তা শ্রয়।’ (সুরা বাকারা, ১৮৪)।
হাদীস শরীফে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যুগে আমরা সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে এক ‘সা’ খাদ্যদ্রব্য আদায় করতাম। তিনি বলেন, আমাদের খাদ্যদ্রব্য ছিল যব কিসমিস, পনির ও খেজুর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫১০)।
অন্য হাদীসে আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন এক ‘সা’ খেজুর বা যব কিংবা আধা ‘সা; গম, গোলাম-আযাদ, নারী-পুরুষ ও ছোট-বড় প্রত্যকের ওপর। (সুনানে আবু দাউদ,হাদীস ১৬২২)।
সদকাতুল ফিতরের কিছু মাসায়াল
* কেউ রমজানের রোজা রাখতে না পারলেও নিসাব পরিমাণ মাল থাকলে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (বাদয়েউস সানায়ে ২/১৯৯)।
* স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামী সদকায়ে ফিতর আদায় করে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীর অনুমতি জরুরি নয়। তবে তা আদায়ের আগে স্ত্রীকে বলে নেয়া ভালো। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/২২৮)।
* ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় ফিতরা আদায় ওয়াজিব হয়। সুতরাং যে সন্তান ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের পর জন্মগ্রহণ করবে তার পক্ষ থেকে বাবাকে সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২০৬)
* বালেগ ছেলেমেয়ে সম্পদের মালিক হোক বা না হোক কোনো অবস্থায়ই তাদের পক্ষ থেকে বাবা বা মাকে সদকা ফিতর আদায় করতে হবে না। আর প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে নিজেরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হলে তাদের ওপরও সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব নয়। অবশ্য তারা যদি নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হয় তাহলে তারা নিজ সম্পদ থেকে তা আদায় করবে। তবে এমন ছেলেমেয়ের পক্ষ থেকে তার অভিভাবক তাদের অনুমতি সাপেক্ষে সদকা ফিতর দিয়ে দেয়, তবে তা আদায় হয়ে যাবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/২০২-২০৩)
* একটি ফিতরার পুরোটা একজন গরিবকে দেয়া উত্তম। অবশ্য এক ফিতরা কয়েকজনকে ভাগ করে দেয়াও জায়েজ আছে। (আল বাহরুর রায়েক : ২/৪৪৬)
* যদি পাগল ছেলের নিজস্ব সম্পদ থাকে এবং সে বাবার তত্ত্বাবধানেই থাকে, তাহলে তার পক্ষ থেকে বাবাকেই সদকায়ে ফিতর আদায় করতে হবে। এ জন্য পাগলের সম্পত্তি ব্যয় করা যাবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/১৯২)
* বাবা-মা, স্ত্রী ও বালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকে সদকা ফিতর আদায় করা ওয়াজিব নয়। তারা নিজেরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাদের ওপর সদকা ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (মারাকিল ফালাহ : ৩৯৫)
* নিতান্ত গরিব ভাইবোনদের সদকাতুল ফিতর দেয়া জায়েজ। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯০)
* নাবালেগ সন্তানদের সম্পদ থাকলে বাবা তাদের সম্পদ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবেন। (মারাকিল ফালাহ : ৩৯৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯২)
* রমজান মাসের ভেতরেও সদকা ফিতর আদায় করা যায়। তবে ঈদের দিন নামাজে যাওয়ার আগে আদায় করে দেয়া উত্তম। কোনো কারণে ঈদের নামাজের আগে দিতে না পারলে ঈদের নামাজের পরও দেয়া যাবে এবং সদকায়ে ফিতরের দায়িত্ব পালিত হবে। (হেদায়া : ১/১৯৩; ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/১৯২)
* কেউ রমজানের রোজা রাখতে না পারলেও নিসাব পরিমাণ মাল থাকলে সদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। কারণ এটা আলাদা বিধান। এর মূল দর্শনের মাঝে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরের বিষয়টি থাকলেও তা ওয়াজিব হওয়া রোজা রাখা না রাখার সঙ্গে যুক্ত নয়। (বাদায়েউস সানায়ে : ২/৫৫৯)।
দৈনিক দেশজনতা/ এমএইচ