সীমান্ত হত্যা বন্ধে গত কয়েক বছরে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। দেশটি বলছিল সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। ২০১৮ সালে এর কিছুটা প্রতিফলন দেখা গেলে বাংলাদেশও তাতে আস্থা রেখেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বাস্তব চিত্র নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
নতুন বছরের প্রথম মাসে অর্থাৎ জানুয়ারির প্রথম ২৩ দিনে বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ বাংলাদেশি। এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার পরপর দুই দিন ছয়জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা বলছে বিএসএফের আচরণ খারাপের দিকেই যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুব উদ্বেগের। তাদের পরামর্শ, সীমান্ত হত্যা বন্ধে বাংলাদেশ যেন যত দ্রুত সম্ভব ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসে।
চলতি মাসে বিএসএফের হাতে ১০ বাংলাদেশি নিহত হন দেশের ছয়টি সীমান্তে। নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চারজন, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার দইখাওয়া এলাকায় বনচৌকি সীমান্তে দুজন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দুজন এবং ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে একজনকে হথ্যা করে বিএসএফ।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চার বাংলাদেশি খুন হন। তাদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে এবং একজন নির্যাতনে।
নওগাঁর পোরশা উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্তের ওপারে বিএসএফের গুলিতে নিহত দুই বাংলাদেশির লাশ এখনো (শুক্রবার রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত) ফেরত দেয়নি ভারত। গতকাল বৃহস্পতিবার দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বৈঠকে ভারত এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে লাশ ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল।
এর আগের দিন বুধবার লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আরও দুজন।
২০১৮ সালে সীমান্তে হত্যার পরিসংখ্যানটি কিছুটা স্বস্তির বার্তা দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সেবার সীমান্তে তিনজন বাংলাদেশি নিহত হন। কিন্তু পরের বছর ২০১৯ সালে তা ১২ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪-এ। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অধিকার-এর সূত্র অনুযায়ী এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৬ এবং ৪১। অধিকার এর নথিপত্রে আরও দেখা যায় ২০১৯ সালে বিএসএফের হাতে অন্তত ৪১ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছে এবং আরও ৩৪ জন অপহৃত হয়েছেন।
চলতি মাসে হঠাৎ সীমান্তে হত্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সীমান্তে একজন মানুষও মারা যাবে না। দুর্ভাগ্যক্রমে, সীমান্ত হত্যা একটি বাস্তবতা। এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।’ বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি ভারতকে জানিয়ে সীমান্ত হত্যা বন্ধে তাদের অঙ্গীকার পূরণ করতে বলবেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
সীমান্তে বিএসএফের বেপরোয়া আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। যত দ্রুত সম্ভব চুক্তি অনুযায়ী এ সমস্যা সমাধানে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল সংশোধন ইস্যুতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বর্ডারে খুব হার্ড লাইনে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা বলছে বর্ডারে বিএসএফের এটিচুইড (আচরণ) খারাপের দিকে যাচ্ছে, যেটা বাংলাদেশের জন্য খুব উদ্বেগের।’
সীমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারের করণীয় সম্পর্কে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘ভারতকে এ বিষয়ে দ্রুত নোটিশ করতে হবে। কেউ অন্যায়ভাবে সীমান্ত পার হতে চাইলে আইনের আওতায় নিয়ে তার বিচার হতে পারে। আমি মনে করি এ বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব ভারতের সঙ্গে বসতে হবে, সঠিক তথ্য তাদের কাছে তুলে ধরে চুক্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।’
গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংসদে জানিয়েছিলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হন। বছর ওয়ারি ২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ জন মারা যান সীমান্তে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বহুবার বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে ভারত সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামাতে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছে।
সীমান্তে হত্যা বন্ধ নিয়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। সেখানে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করতে একমত হয় দুই দেশ। এর ফল পাওয়া গিয়েছিল সেবার- মাত্র তিনজনের প্রাণহানি হয়।
পরের বছরটি ছিল হতাশাজনক। সদ্য শেষ হওয়া ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ভারতের দিল্লিতে বিজিবি-বিএসএফের ডিজি পর্যায়ের বৈঠকের পর বিজিবির প্রধান গণমাধ্যমকে সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। এর জবাবে বিএসএফ আরও সতর্ক ও সজাগ থাকার আশ্বাস দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই জাতীয় অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু এড়ানো যায়।
কিন্তু সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চলছেই। আর প্রতিবারই পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে আর ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় হত্যাকাণ্ড বন্ধ করবে তারা।
সীমান্ত হত্যার বেশির ভাগই গরু চোরাচালান ইস্যু
সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের সিংহভাগ গরু চোরাচালানে জড়িত ছিল বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে। কাঁটাতারের বেড়া কেটে বা বেড়া ডিঙিয়ে পার হওয়ার সময় তাদের গুলি করে বিএসএফ। বিজিবি এই বিষয়টি চিহ্নিত করলেও গরু চোরাচালান বন্ধে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বর্তমান সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ বিজিবির মহাপরিচালক থাকাকালে ২০১৬ সালের ৭ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, সীমান্ত হত্যার পেছনে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী গরু চোরাচালান।
ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু পাঠানো বন্ধের ঘোষণা দেয়। এরপর বাংলাদেশে পশু পালন বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। এরই মধ্যে গবাদি পশুতে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। তার পরও একশ্রেণির চোরাচালানি ভারত থেকে গরু আনার প্রবণতা বন্ধ হয়নি।