সাক্ষীদের জবানবন্দিতে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত আসামি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহার আমলনামা ফুটে উঠেছে।
এর আগেও অমিত সাহা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে লাঞ্চিত ও অপমান করে। শুধুমাত্র সালাম না দেয়ার অপরাধে বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাখাওয়াত হোসেন অভিকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেয়। পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে অভি এমন তথ্য দিয়েছে।
অভি জানায়, গত ৬ অক্টোবর রাত ৮টার দিকে ১৬তম ব্যাচের মনিরুজ্জামান মনির ম্যাসেঞ্জারে সবাইকে নিচে আসতে বলে। ওই ম্যাসেজ দেখে রুম থেকে নিচে নামি। নিচে নেমে কাউকে দেখতে না পেয়ে ১০০৭ নং রুম এর সামনে দাঁড়িয়ে ৪০০৬ রুম এ থাকা সাইফুলকে ভাত খাওয়ার জন্য ফোন দিয়ে নিচে আসতে বলি। সাইফুল নিচে নামলে ক্যান্টিনের বাইক স্ট্যান্ডে ১৭তম ব্যাচের এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুনতাসির আল জেমি, নাজমুস সাদাত, হোসাইন মোহাম্মদ তোহাকে দেখতে পেয়ে আমরা সেখানে যাই।
ওদের জিজ্ঞাসা করি, ভাইয়েরা ডাকছে কোথায়? তানিম বলেন, আগে আমাদের সাথে ১০১১নং রুমে চল, আবরারকে ভাইয়েরা ডাকছে। এরপর ওদের পিছে পিছে আমি ও সাইফুল ১০১১ রুমে যাই। ওই রুমে সৈকত ইসলাম অন্তিম এর সাথে কথা বলি এবং এহতেশামুল রাব্বি তানিম ঘুম থেকে ডেকে তুলে আবরারকে। বলে, তোকে ভাইয়েরা ২০১১নং রুমে ডেকেছে।
এরপর আবরার ফ্রেশ হয়ে আসে। ১০১১নং রুম থেকে বের হওয়ার সময় তানিম আমাকে ও সাইফুলকে বলে তোরাও চল। তখন ওদের পিছে পিছে বের হওয়ার সময় ১৭তম ব্যাচের শামীম বিল্লাহকে ১০০৮নং রুমের সামনে দেখি এবং তার হাতে নতুন হেলমেট দেখি। আমি সাইফুল ইসলাম, শাহিন আলম হেলমেটটি দেখি।
এ সময় এহতেশামুল রাব্বি তানিম ও এএসএস নাজমুস সাদাত আবরারকে নিয়ে ২য় তলায় ২০১১নং রুমের দিকে যায়। হেলমেট দেখার সময় হোসাইন মোহাম্মদ তোহা আমাকে ও সাইফুলকে আবারও ২০১১নং রুমে যেতে বলে। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই কারণ, ৭/৮ মাস আগে সালাম না দেয়ার অপরাধে ১৬তম ব্যচের অমিত সাহা আমাকে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের ছাদে নিয়ে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙে দিয়েছিল।
সে জানায়, রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে আমি এবং সাইফুল ২০১১নং রুমে গিয়ে সেখানে ১৬তম ব্যাচের মনিরুজ্জামান মনির, তাবাখরুল ইসলাম তানভির, মুজতবা রাফিদ, ইফতি মোশাররফ সকাল, ১৭তম ব্যাচের নাজমুস সাদাত, হোসাইন মোহাম্মদ তোহা, তানিমসহ আরো কয়েকজনকে খাটে বসে থাকতে দেখি। আবরারকে ওই রুমের মধ্যে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখি। আমি এবং সাইফুল খাটে বসি। ওই সময় জেমি আবরারের দুইটা ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে ১৬তম ব্যাচের ওই ভাইদের কাছে চেক করার জন্য দেয়।
এরপর একে একে ১৭তম ব্যাচের সামছুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মোহাম্মদ গালিব, আবু নওশাদ সাকিব, মাজেদ এবং ১৬তম ব্যাচের মুজাহিদুর রহমান ২০১১নং রুমে প্রবেশ করে।
এরপর একটি মোবাইল মুজতবা রাফিদ, অন্যটি ইফতি মোশাররফ সকাল এবং ল্যাপটপটি তাবাখারুল ইসলাম ও মনিরুজ্জামান মনির চেক করতে থাকে।
আবরার শিবির করে কী না তা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। তারা আবরারের ফেসবুকও চেক করে। ৩০/৪০ মিনিট চেক করার পর ইফতি মোশাররফ আবরারকে জিজ্ঞাসা করে, তুই কী শিবির করিস? আবরার তখন না বলে। আবরার কখনো শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে জানায়।
অভি বলে, এর মধ্যে মুজতবা রাফিদ রুম থেকে চলে যায়। রাত ৯টার পরপরই ১৫তম ব্যাচের অনিক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মেহেদী হাসান রবিনসহ ২০১১ রুমে আসে এবং মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ পুনরায় চেক করে। ইফতি মোশাররফ, রাফিদ, মনিরুজ্জামান মনির, তাবাখরুল ইসলাম ততক্ষণ চেক করে কি পেয়েছে তাদের দেখায়।
এরপর জিয়ন ও মেহেদী হাসান আবরারকে জেরা শুরু করে। জেরার এক পর্যায়ে মেহেদী হাসান ৯টা ৪৫ মিনিটের সময় আবরারের মুখে চড়-থাপ্পড় মারা শুরু করে। এরপর জিয়নও আবরারের কানে, মুখে চড়-থাপ্পড় মারা শুরু করে।
এদের মারার পর ইফতি মোশাররফ আবরারের মুখে, কানে এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড় মারা শুরু করে। অনেকক্ষণ মারার পর ইফতি মোশাররফ ক্রিকেট স্ট্যাম্প আনতে বললে ১৭তম ব্যাচের কোন একজন তা নিয়ে আসে।
পরে স্ট্যাম্প দিয়ে ইফতি মোশাররফ নিতম্বে মারতে শুরু করে আবরারের । মারতে মারতে স্ট্যাম্পটি দুটুকরো হয়ে যায়।
স্ট্যাম্পটি ভেঙ্গে গেলে এহতেশামুল রাব্বি তানিম আরেকটি স্ট্যাম্প নিয়ে আসে। সেই ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে অনিক সরকার এলোপাথাড়িভাবে আবরারের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড জোরে নির্মমভাবে আবরারকে মারতে শুরু করে।
এরপর জোর করে স্বীকার করতে বলে, বল তুই শিবির করিস। আবরার না বললে অনিক জোরে জোরে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে মারতে থাকে। রুমে উপস্থিত অনেকেই আবরারকে কিলঘুষি লাথি মারে, ভাঙ্গা স্ট্যাম্প দিয়েও মেরেছিল অনেকে।
উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় আবরার ফাহাদকে উদ্ধার করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরার ফাহাদকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন বেদম পেটায়।
এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। আবরার বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন।