আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, গত দেড় মাসে সমুদ্রপথসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুইশ রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এদের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময়, বাকিরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বাংলাদেশি পাসপোর্টসহ বা তা সংগ্রহকালে আটক হয়েছে। তারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এরমধ্যে সর্বশেষ ১৩ নভেম্বর সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ১২২ জন রোহিঙ্গাবাহী একটি ট্রলার আটক করে কোস্টগার্ড। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১৫ জন শিশু, ৫৯ জন নারী ও ৪৮ জন পুরুষ ছিল।
তবে সম্প্রতি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রা কিংবা দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে রোহিঙ্গা শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল কক্সবাজার জেলা পুলিশ।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘এ সময়ে সমুদ্র শান্ত থাকায় পাচারকারীরা মানবপাচারের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু পাচার রোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিবাসন প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের পালানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সতর্কতা বাড়িয়েছে সরকার। ফলে পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) ও গোয়েন্দা সংস্থারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’
পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ মাসে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় প্রায় ছয়শ’ জনকে উদ্ধার করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এদের মধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী ও শিশুও ছিল।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৮ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে; যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্রযাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ, কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু।
জানা গেছে, ট্রলারে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানো জন্য মানবপাচারকারীরা কক্সবাজারের উপকূলের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট ব্যবহার করছে। তা হলো−টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালি, রাজারছড়া, জাহাজপুরা, সবারাং, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াপাড়া, খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডি, মহেষখালী। সীতাকুণ্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়ে ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা। তারা সবাই টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। এছাড়া মালয়েশিয়া অবস্থানকারী মানবপাচারকারী কয়েকজন রোহিঙ্গার নামও উঠে এসেছে। ১৩ নভেম্বর সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় আটক যাত্রীরা হামিদ নামে একজন রোহিঙ্গা দালালের নাম স্বীকার করেছে।
উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা নুর কালাম বলেন, ‘সাধারণত মালয়েশিয়া নেওয়ার জন্য রোহিঙ্গা নারীরা পাচারকারীদের টার্গেটে থাকে। প্রথমে ফোনের মাধ্যমে বিদেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে নারীদের রাজি করানো সহজ হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমার শিবির থেকে অনেক রোহিঙ্গা বের হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধরা পড়লেও অনেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তা আমি নিশ্চিত নই।’
আরেক রোহিঙ্গা সৈয়দ আলম জানান, যেসব রোহিঙ্গার আত্মীয়-স্বজন মালয়েশিয়ায় বসবাস করছে, তারাই ওই দেশে যেতে বেশি আগ্রহী। আবার যাদের আত্মীয়-স্বজন সেখানে নেই, তারাও উন্নত জীবনের আশায় এবং অবিবাহিত নারীরা বিয়ের প্রলোভনে মালয়েশিয়া যেতে চায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাওয়া ত্রাণসামগ্রী বিক্রি করে সেই টাকা দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে।
নজরদারির অভাবে ফের মানবপাচার শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’ নামে সংগঠনের সমন্বয়ক এইচএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর আবারও সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে। এখনই সরকার মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে অতীতের মতো বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
না বলার শর্তে একজন জনপ্রতিধি বলেন, ‘প্রশাসনের অবহেলার কারণে সীমান্তে মানবপাচার হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের একটি চক্র মানবপাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বিদেশ থেকে মানবপাচারের একটি চক্র তাদের সহযোগিতা করছে। ফলে ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে হবে। না হলে মানবপাচার বড় রূপ নিতে পারে।’
কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার বলেন, ‘মানবপাচার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কোনোভাবেই মানবপাচার হতে দেওয়া হবে না। কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।’
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে প্রাণের ভয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রিত ছিল আরও চার লাখের মতো রোহিঙ্গা। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে।