বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সড়কে অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা সম্পর্কে আগেভাগে জানতে বা সড়কে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা থাকে যার সাথে সমন্বয় রেখে কাজ করে পুলিশ, উদ্ধারকর্মী, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবাই।
বাংলাদেশেও এরকম একটি ব্যবস্থা চালু করার জন্য একটি পাইলট প্রকল্পের ব্যাপারে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার
ধরুন আপনি বাংলাদেশের যেকোনো মহাসড়ক ধরে দেশের কোন জেলায় যাচ্ছেন। হঠাৎ লম্বা যানজটে পরলেন যার কারণ আপনি জানেন না।
সেসব তথ্য যাত্রী, চালক, পুলিশ বা হাসপাতালে পৌঁছাতেও অনেক সময় লেগে যায়।
ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম
যে ব্যবস্থা চালু করার ব্যাপারে কথাবার্তা হচ্ছে সেটি হল ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম।
এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল করিম। তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন বিষয়টি আসলে কী।
তিনি বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য হল দেশের সকল সড়ক মহাসড়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখা যাতে কোন ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে সেটি জানা ও দেখা যায় এবং ব্যবস্থা নেয়া যায়।
আইন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাস্তায় কি বদলেছে কিছু?
প্রকৌশলী একেএম ফজলুল করিম বলেন, যেমন এখন কী হচ্ছে? হাইওয়েতে একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। এটার খবর নিকটবর্তী থানা, হাইওয়ে পুলিশ বা হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। এর ফলে দুটো জিনিস ঘটে। একটি হল দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের চিকিৎসায় দেরি হয় এবং ওই দুর্ঘটনার কারণে মহাসড়কে বিশাল লম্বা যানজট তৈরি হয়ে যায়। একটা কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক যদি নজরদারি চলে তাহলে সাথে সাথে ঘটনা জানা যাবে ও ব্যবস্থা নেয়া যাবে
যেভাবে কাজ করবে এই ব্যবস্থা
যেমন সারাদেশের মহাসড়কজুড়ে হাজার হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। গাড়ির গতি পরীক্ষার জন্য থাকবে গতি নির্ধারক সেন্সর-যুক্ত ক্যামেরা।
সেগুলো থেকে যে ছবি ও তথ্য আসবে তা কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় পর্যবেক্ষণ হবে। নানা যায়গায় বার্তা সম্বলিত ডিজিটাল বোর্ড বসানো হবে।
হাইওয়ে পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ সবার পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
যে যার মতো ঘটনাস্থলে চলে যাবে। যার যা করার কথা সে সেই দায়িত্ব পালন করবে।
সড়ক নিরাপত্তা ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ
গতি নির্ধারক সেন্সর-যুক্ত ক্যামেরা যা জানতে পারবে যেমন কোন গাড়ি কত গতিতে অতিক্রম করছে ক্যামেরার বার্তা ছবিসহ চলে যাবে পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে।
প্রকৌশলী একেএম ফজলুল করিম বলেন, যেমন কোন গাড়িটা কোনদিকে যাচ্ছে, কত গতিতে যাচ্ছে, আইন ভঙ্গ করছে কিনা, প্রতি ঘণ্টায় কতগুলো গাড়ি একটি এলাকা দিয়ে গেলো সেসব তথ্য রেকর্ড হতে থাকবে। ভেহিকেল ডিটেকশন সিস্টেম থাকবে। অর্থাৎ কোন ধরনের গাড়ি, তার আকার ও তা কত লোক বহন করছে সেটা ডিটেক্ট করা যাবে।
উন্নত বিশ্বে লাইসেন্স নম্বরের ছবিসহ জরিমানার চিঠি পাঠানো হয় চালকদের। সেরকম ব্যবস্থা এখানে করার কথা ভাবা হচ্ছে যাতে করে আইন ভঙ্গ করার বিষয়ে চালকরা সাবধান হন।
পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের এসব তথ্য হাইওয়ে পুলিশও ব্যাবহার করবে মহাসড়কে নানা ধরনের অপরাধ দমনে। প্রকৌশলী একেএম ফজলুল করিম বলেন, একই ক্যামেরা সব ধরনের ঘটনাকে ডিটেক্ট করতে পারছে। যা অপরাধ দমনে ব্যবহার করা যাবে।
সাধারণ জনগণের উপরও নজরদারির সুযোগ থাকছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে নতুন এই পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে ঘিরে। তবে সেই সুযোগকে কীভাবে কাজে লাগানো হবে তা পরিষ্কার নয়।
যানজটের অগ্রিম তথ্য
সড়কে ডিজিটাল বোর্ডে নানা ধরনের অগ্রিম বার্তা দেয়া হবে। সামনে যানজট আছে কিনা, দুর্ঘটনা হয়েছে কিনা, গাড়ির গতি কমানোর, বিকল্প সড়ক ব্যবহারের নির্দেশনা আছে কিনা, গুগল ম্যাপের মতো সবচেয়ে ভালো সড়ক সম্পর্কে তথ্য, পৌঁছানোর সম্ভাব্য সময় এমনকি আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্যও থাকবে।
সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে যে তথ্য আসবে সেটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে অগ্রিম বার্তা হিসেবে ডিজিটাল বোর্ডে চলে আসবে।
এসব বিষয় জানাতে ডিজিটাল বোর্ড ছাড়াও মোবাইল অ্যাপ চালু করা হবে।
আপাতত যা পরিকল্পনা করা হচ্ছে
সরকার এই ব্যাপারে একটি দীর্ঘমেয়াদী মাল্টি-প্ল্যান নিয়ে ভাবলেও আপাতত একটি পাইলট প্রকল্প চালু করার চিন্তা করা হচ্ছে।
ঢাকা থেকে দাউদকান্দির দিকে যেতে চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৪০ কিলোমিটার জুড়ে পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই ব্যবস্থা চালু করার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেটির জন্য বাংলাদেশ কোরিয়ান সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। কোরিয়া থেকে একটি দল একবার এসে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে ইতিবাচক উত্তর দিয়েছে।
কোরিয়ান সরকারের অনুদানে হবে এই পাইলট প্রকল্প যার জন্য আপাতত ৯০ কোটি ডলার দিচ্ছে তারা।
প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত দিক দিয়েও তারাই সহায়তা করবে। এব্যাপারে আরও কথা বলতে আজ (রবিবার) দক্ষিন কোরিয়া থেকে আর একটি দল আসছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কে নানা দিক আলোচনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের বাংলাদেশে থাকার কথা। তবে এই সফরেই কিছু চূড়ান্ত হবে কিনা সেটি নিশ্চিত নয়।
আগামী বছর থেকে পাইলট প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করার আশা করছে সরকার।
কোন কিছুই এখনো চূড়ান্ত না হলেও সারা দেশে সুফল পেতে দশ বছরের মতো লেগে যেতে পারে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এর কতটা সুফল পাওয়া যাবে?
শুনতে বেশ গালভরা মনে হচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে।
বাংলাদেশের সড়কে রয়েছে নানা ধরনের ছোট ও কম গতির বাহন।
মহাসড়কের পাশে রয়েছে ব্যস্ত বাজার, চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, পথচারীদের জন্য ব্যবস্থার অভাব এই সবকিছু মিলিয়ে দেশের যানবাহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের প্রধান অধ্যাপক মিজানুর রহমান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বাংলাদেশের এই প্রেক্ষাপট মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
তিনি বলছেন, সড়ক ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে শেষ ধাপ হচ্ছে প্রযুক্তি। এর আগে আরও বেশ কটি ধাপ রয়েছে। সেগুলো কী আমরা ব্যবহার করেছি?
এর একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, যেমন ধরুন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চার লেন করা হয়েছে। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে অনেক গাড়ি উল্টোদিকে চলে আসছে। এইরকম বিষয়গুলোতে আইন প্রয়োগেরও দরকার আছে।
তিনি বলছেন, প্রযুক্তির সুফল যদি আমরা পেতে চাই তাহলে যারা সড়ক ব্যবহার করেন বিশেষ করে চালক ও গাড়ির মালিক তাদের মনোভাব পরিবর্তনের দরকার আছে। তাদের বিষয়টি আগে জানানোর দরকার। তা না হলে এর সুফল হয়ত পাওয়া যাবে না।
সড়কে নিয়ম ভঙ্গ করার প্রবণতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, খারাপ মানের গাড়িই যদি রাস্তায় চলে তাহলে প্রযুক্তি দিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হবে বলে তিনি মনে করেন।