দেশজনতা অনলাইন : খন্দকার মাহমুদুল হাসানের ‘বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাচীন’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর পৌরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য নবাব পরিবার আর্থিক সহায়তা করে। ফলে ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে ঢাকাবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য পানির ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে তারও আগে ঢাকা শহরে সাক্কা বা ভিস্তিওয়ালারা গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত মশকের সাহায্যে পানি সরবরাহের কাজ করত। সাক্কারা যেখানে বাস করত তা এখন সিক্কাটুলী নামে পরিচিত।
পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে ঢাকা শহরে পানি সরবরাহকারী প্রথম পানির ট্যাংকটি অবস্থিত।
ট্যাংকটি চলে গেছে দখলদারের খপ্পরে। সেখানে এখন চলে নানা অপকর্ম। জায়গাটি এখন স্থানীয় উঠতি বয়সিদের আড্ডার স্থান। পাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি দোকান, এমনকি সেখানে চলে মাজারের কাজ। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ট্যাংকটি ব্যবহার করা হচ্ছে। ঢাকার তৎকালীন কমিশনার পিকক সাড়ম্বরে এর উদ্বোধন করেন।
ঢাকাবাসীর সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য অর্থদানসহ সবিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকার নবাব পরিবার। ১৮৭১ সালে নবাব আবদুল গণি পেয়েছিলেন কেসিএমআই (কিং কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া) উপাধি। গণি মিয়া নামেই তিনি এলাকায় খ্যাত। উপাধি পাওয়ার আনন্দে ঢাকাবাসীর কল্যাণের জন্য তিনি দান করেন ৫০ হাজার টাকা। উদ্দেশ্য ঢাকাবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা। তার এই অর্থের সঙ্গে পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ যোগ করলেন আরো ৫০ হাজার টাকা। তবে ঢাকা প্রকাশ সূত্রে জানা যায়, ‘নবাব গণি জলের কলের জন্য ৩ বারে ২ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন।’ এর আগে ঢাকাবাসীর পানীয় জলের উৎস ছিল শুধু মহল্লার পুকুর বা কুয়া।
বিশুদ্ধ পানির অভাবে ঢাকায় উদরাময়, কলেরাসহ নানা রোগব্যাধিতে প্রতিবছরই অনেক লোক মৃত্যুবরণ করত। নবাব আবদুল গণির দান করা টাকা দিয়ে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিতে গঠিত হয় কমিটি। মিটিংয়ের পর মিটিং হতে থাকে নবাব ও ইংরেজ কর্মকর্তাদের মধ্যে। লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেলের নির্দেশনায় ঢাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বিষয়ক যেসব চিঠিপত্র চালাচালি হয়েছিল, সেগুলো গেজেট আকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এসব কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত ১৮৭৪ সালে লর্ড নর্থব্রুক ঢাকার ওয়াটার ওয়ার্কস প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। তবে সেটা ছিল বাস্তব কাজের সূচনামাত্র। পুরো প্রকল্প নির্মাণ ও পাইপের মাধ্যমে ঢাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানি পেতে আরো অন্তত চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঢাকার কমিশনার পিকক দৈনিক দুই লাখ গ্যালন পরিমাণ পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উদ্বোধন করেন। সব মিলিয়ে এ কাজে নবাব পরিবারের ব্যয়ের পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল নয় লাখ পাঁচ হাজার ৩৫০ টাকা। এটাই এই অঞ্চলের মানুষের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের প্রথম ঘটনা।
প্রথমে এ কাজে পাইপের দৈর্ঘ্য ছিল চার মাইল, আর তা গিয়েছিল তিন দিকে। পানির একটি পাইপলাইন গিয়েছিল মিটফোর্ড হাসপাতাল বা বর্তমান সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের দিকে। এ পথে ছিল চকবাজার ও কোতোয়ালি এলাকা। অন্যটি কোতোয়ালি থেকে লোহারপুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নারিন্দা এলাকা ছিল এর আওতাভূক্ত। আর তৃতীয় পানির লাইনটি গিয়েছিল পুরান ঢাকার জেলখানা এলাকায়। শুরুর চার বছরের মধ্যেই নগরবাসীর মধ্যে সরবরাহ করা পানির চাহিদা বেড়ে যায়। নবাব আহসানউল্লার দানে পরে নবাবপুর থেকে ঠাটারীবাজার হয়ে দিলকুশা পর্যন্ত পানি সরবরাহের জন্য একটি নতুন পাইপলাইন বসানো হয়। এরপর খুব দ্রুততার সঙ্গেই পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহের আওতাধীন এলাকা বেড়ে গিয়ে ১৮৯৩ সালে প্রায় ১৬ মাইল দীর্ঘ পাইপ বসানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছিল।
উল্লেখ্য, প্রকল্পটি শুরুর সময় ঢাকাবাসীর এই সুবিধা প্রাপ্তিতে পরবর্তী সময়ে তাদের ওপর কর আরোপ করা হতে পারে এমন আশঙ্কা করেছিল নবাব পরিবার। এটি যাতে না হয়, সে জন্য তারা শর্ত জুড়ে দেন— বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারকারীদের ওপর কর আরোপ করা চলবে না। কিন্তু পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল বলে এটি টিকিয়ে রাখতে বছরের পর বছর এর পেছনে অর্থ ব্যয় প্রয়োজন। প্রকল্প সমাপ্তির পরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৌরসভাকে দেয়ার জন্য বলা হলে পৌরসভা তাদের পর্যাপ্ত অর্থ নেই বলে পানি সরবরাহের পরিবর্তে ঢাকাতে স্কুল অব আর্টসের জন্য টাকা খরচের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু নবাব পরিবার তাতে সম্মতি দেয়নি। নবাব আহসানউল্লাহ জানান, শুধু বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজেই এ টাকা ব্যয় করা যাবে। এই কাজে আরো ৫০ হাজার টাকা তিনি দেয়ার ঘোষণা দেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা ওয়াসা (পানি সরবরাহ ও নর্দমা ব্যবস্থা অথরিটি) ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।
স্থানীয় প্রবীণ হায়দার আলী জানান, এই পানির ট্যাংক আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। কিন্তু জায়গাটি যেভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হয় না বেশিদিন টিকবে। ওয়াসা ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিৎ ট্যাংটিকে তাদের অধীনে নিয়ে নেয়া। যাতে এর ইতিহাস সাধারণ মানুষ জানতে পারেন। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না এটা কী ছিল? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুরান ঢাকার ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মো. সেলিম জানান, এই ট্যাংকের মালিক ওয়াসা। তাদের সম্পত্তিতে আমি কি করতে পারি? তাছাড়া ওরা আমার মহল্লার ছেলে। যা করার ওয়াসাকেই করতে হবে। বিষয়টি জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসনিক) মো.মাহমুদ হাসান বলেন, আমাদের তালিকাভুক্ত সকল সম্পত্তি উদ্ধারের কাজ আমরা শুরু করেছি। যেখানেই এবং যার কাছেই আমাদের সম্পত্তি থাক না কেন আমরা উদ্ধার করব। প্রথম পানির ট্যাংকের বর্তমান অবস্থা জানেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা এখনো আমার জানা নেই। তবে এমন কিছু হয়ে থাকলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংক নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রথম পানির ট্যাংকটি আমাদের অধীনে নয়। তবে পুরান ঢাকার বেশ কিছু পুরোনো বাড়ি যেগুলোর বয়স শত বর্ষের বেশি সেগুলো না ভাঙার নির্দেশ দেয়া আছে। সেক্ষেত্রে যদি এটি এই ক্যাটাগরিতে পড়ে তবে এটাও আমরা সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।