আষাঢ়ের শেষের দিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা শুরু হয়েছে। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়ে গেছে রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের বেশ কিছু জেলা। মূলত উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীবেষ্টিত জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, শেরপুর, জামালপুর এবং সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলে বিশেষ করে হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে বানের পানিতে ভেসে গেছে সব। শুকনো জায়গার অভাবে নৌকায়, বাঁধে ও বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবনযাপন করছেন লাখ লাখ মানুষ। ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে। এই শ্রাবণেও সেখানে বৃষ্টির দেখা নেই। পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। গরমে ওষ্ঠাগত মানুষ। হাহাকার দেখা দিয়েছে আউশ ও আমন চাষিদের মধ্যে। এমনকি বৃষ্টি প্রার্থনা করে সাতক্ষীরায় বিশেষ মোনাজাতের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
আষাঢ়ে সময় মতো প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ায় আউশ ধানের কচ বের হতে দেরি হয়। শেষের দিকে কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় আমন আবাদ নিয়ে আশার সঞ্চার হয় কৃষকদের মধ্যে। কিন্তু এরপর বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের বীজতলা তৈরি নিয়েই হতাশা দেখা দিয়েছে তাদের ভেতর।
খুলনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার জানান, শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও বৃষ্টির দেখা নেই। সম্প্রতি হালকা বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তা কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি। খুলনায় ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বৃষ্টিহীনতার মধ্যেই আমনের বীজতলা তৈরির কাজ চলছে। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে আউশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন আমনের ওপরও বৃষ্টিহীনতার প্রভাব পড়ার শঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ জানান, বিচ্ছিন্নভাবে শহর ও কয়েকটি উপজেলায় হালকা বৃষ্টি হলেও তা হিসেবের খাতায় আনার মতো না। ২০১৮ সালের জুন মাসে খুলনায় বৃষ্টিপাত ছিল ২৬৪ মিলিমিটার (মি.মি.) এবং জুলাই মাসে ছিল ২৬৬ মি.মি.। কিন্তু এই বছরের জুন মাসে খুলনায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১১৫ মি.মি.। আর জুলাই মাসের এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫৭ মি.মি.।
বৃষ্টির অভাবে বীজতলা তৈরি করতে পারেনি জেলার অধিকাংশ কৃষক। এদিকে জেলায় পাটের ফলন ভালো হলেও খাল-বিলে পানির অভাবে পাট পচানো বা জাগ দেওয়া নিয়ে বিপাকে আছেন কৃষকরা। বৃষ্টি কামনায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় ইস্তেস্কার নামাজ আদায় করা হয়েছে।
পানির অভাবে জমিতে চাষ কাজ করতে পারছেন না কৃষকরা। এর মধ্যে সদরের রাজার বাগান, মাছখোলা, শাল্যে, আলিপুর, ভোমরা, শিবপুর, লাবসাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির অভাবে ধানের বীজতলা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে জমিতে পানি দিয়ে আমনের চারা রোপণ করছেন।
জেলা আবহাওয়া অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত মৌসুমের মে মাসে ১৫০ মি.মি.,জুন মাসে বৃষ্টিপাত হয় ২৫৯ মি.মি ও জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত ২৪১মি.মি বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এবার মে মাসে ১১৭ মি.মি., জুন মাসে ২১৮ মি.মি ও জুলাই মাসে এখন পর্যন্ত মাত্র ৭০ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সদরের রাজার বাগান এলাকার কৃষক আবুল হোসেন বলেন, ‘এবার বৃষ্টির দেখা নেই। বোরো ধান ওঠানোর পর মোটরপাম্প ঘরে এনে রেখেছিলাম। পাওয়ার হাউস থেকে সেসময় বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়ে গেছে। নতুন করে লাইন লাগিয়ে আমন চাষ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক অরবিন্দু বিশ্বাস বলেন, ‘চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কৃষকরা আউশ, আমনের বীজতলা ও পাট পচানো নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন। জমি তৈরি করতে সমস্যা ও বীজতলায় বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দিচ্ছে।’
শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ পার হলেও তেমন বৃষ্টির দেখা নেই যশোরে। সেকারণে বীজতলা করেও ভূঁই (ক্ষেত) করতে পারছেন না কৃষকরা। বিকল্প হিসেবে ব্লকের (সেচ দিয়ে) চিন্তা ভাবনা করছেন তারা। সেক্ষেত্রে আমনচাষে এবার খরচ বাড়বে। খালে-বিলে পানি না থাকায় সমস্যা হচ্ছে পাট জাগ দিতেও।
আমন চাষের ব্যাপারে যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার কড়ইতলা এলাকার কৃষক বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি না হলে ব্লকে করতে হবে। সেক্ষেত্রে তিন থেকে চার হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে সচে।’
দুই বিঘে পাট করেছি। যেখানে ১০-১২ হাত পর্যন্ত পাটের উচ্চতা হয়, সেখানে এবার হয়েছে ৫ থেকে ৬ হাত পর্যন্ত। পানির অভাবে পাট এখনও কাটিনি। বৃষ্টি না হলে ডোবার পানিতে পচাতে হবে। তখন পাটের রঙ হবে না, দামও কম পাওয়া যাবে।’
কেশবপুর উপজেলার রঘুরামপুর এলাকার কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘মাইল খানেক দূরে কপোতাক্ষ নদ। কিন্তু নদও কচুরিপানায় ভর্তি। সেখানে পাট জাগ দিতে হলে অতিরিক্ত পরিবহন খরচের বিষয় রয়েছে। বৃষ্টির আশায় এখনও পাট ক্ষেতেই রেখেছি।’
যশোর বিমানবন্দর মতিউর রহমান ঘাঁটি আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় গত বছর জুন মাসে ২২২ মি.মি. এবং জুলাই মাসে ৩৫৩ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এবছর জুন মাসে ১৫৫ মি.মি. এবং চলতি জুলাই মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ১৪৩ মি.মি. বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সুশান্ত তরফদার বলেন, ‘বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবার সময়মতো আমন চাষ শুরু করতে পারেনি কৃষকরা।’
ভরা বর্ষায় বৃষ্টির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। একই অবস্থা হয়েছে চিংড়ি ঘেরেও। মৌসুমে আমন আবাদের পাশাপাশি ঘেরের পাড়ে সবজি আবাদ করা হয়। জেলার ফকিরহাট, মোল্লাহাট, সদর, রামপাল ও চিতলমারী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সবজি উৎপাদন হয়। আর এসব সবজি রাজধানীসহ দেশে বিভিন্ন স্থানে ট্রাক যোগে পাঠানো হয়। এবার সবজি চাষিদের ও মাথায় হাত পড়েছে।
চিতলমারী উপজেলার কুরমুনি গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম জানান, তার কয়েকটি মাছের ঘেরের পাড়ে প্রতি বছর শত শত মণ সবজি উৎপাদন করেন। এবছর বৃষ্টির অভাবে সবজির চারা বপন করতে পারেননি ।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আপতার উদ্দিন জানান, এবছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় কৃষকদের বিআর-২৩ জাতের ধানসহ নাবি জাতের ফসল চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এই বর্ষায় মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়েছে। তবে বৃষ্টিপাত কিছুটা কম হওয়ায় জেলার জিকে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) সেচ সুবিধার বাইরে থাকা ৩৫ হাজার হেক্টর জমির চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প ব্যবস্থায় চাষ করা গেলেও খরচ বেশি হচ্ছে।
কুষ্টিয়া আবহাওয়া কর্মকর্তা মামুন আর রশিদ জানান, জুন মাসে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২৪২ মি.মি.। আর চলতি জুলাই মাসে এখন পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ রয়েছে মাত্র ৮৮ মি.মি.। তবে এখনও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে বলেও জানান তিনি।
বৃষ্টির জন্য বিশেষ মোনাজাত
দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল বানের পানিতে ডুবে গেলেও বৃষ্টির দেখা নেই দক্ষিণ-পশ্চিমে। ভরা বর্ষায় বৃষ্টির জন্য তাই বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছে সাতক্ষীরায়। ফসল আবাদের জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টি কামনায় ২১ জুলাই কলারোয়া উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের মুড়াগাছা এলাকার মুড়াগাছা বিলে ইস্তিস্কার নামাজ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। ২২ জুলাই উপজেলার কেঁড়াগাছি ইউনিয়নের কাঁকডাঙ্গা সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা সংলগ্ন হেড়ের বিল নামক ফসলি মাঠে ইস্তেস্কার নামাজ আদায় করেছেন এলাকাবাসী।
নামাজে অংশগ্রহণকারীরা জানান, আষাঢ়-শ্রাবণের পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতে কৃষক তার জমিতে ফসল ফলায়। কিন্তু এই বছর খরা যাওয়ায় কৃষক জমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। মাছ চাষিরা করতে পারছেন না মাছ চাষ। এজন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মিলে বৃষ্টি কামনায় দোয়া করা হয়েছে।