নিজস্ব প্রতিবেদক: নগর ভবনে দুই বছর পূর্ণ করেছেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) দুই মেয়র। এরইমধ্যে নগরবাসীর কাছে দুই মেয়রে অাস্থা বেড়েছে। হকারমুক্ত ফুটপাত, অবৈধ যানবাহন ও অনিরাপদ খাদ্যের বিরুদ্ধে অভিযান, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণ, সড়ক সংস্কার, এলইডি বাতি, সিসি ক্যামেরা, পাবলিক টয়লেট, ফ্রি ওয়াইফাই জোন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অস্থায়ী স্টেশন স্থাপন, দৃশ্যমান উন্নয়নসহ নানা কাজে সন্তুষ্ট হচ্ছেন নগরবাসী। তবে মশা এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতায় এই অর্জন ম্লান হতে বসেছে
দুই সিটি কর্পোরেশনের অন্যতম সমস্যা ছিল ফুটপাত। এ সমস্যা সমাধানে কঠোর সিদ্ধান্ত নেন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। শুধু উচ্ছেদ নয়, উচ্ছেদকৃত হকারদের বিদেশ পাঠাতেও পরিকল্পনা নেয় ডিএসসিসি। উত্তরের মেয়র আনিসুল হকও বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন।
রাজধানীর ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তানের ফুটপাত তো দূরের কথা এর রাস্তা দিয়েও হাঁটাও যেত না। সেই ফুটপাতের চেহারা এখন বদলে গেছে। নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনী চক শপিং কমপ্লেক্স ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার চিত্রও ছিল একই। এসব স্থান এখন পথচারীদের জন্য উন্মুক্ত। সম্প্রতি কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে এসব এলাকা থেকে হকার উঠিয়ে দেয় দক্ষিণ সিটি। এই এলাকার চিরায়িত চিত্র এখন বদলে গেছে। হকারমুক্ত ফুটপাতে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করছে মানুষ।
নগরীর সমস্যা সমাধানে গত দুই বছরে বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন ঢাকার দুই মেয়র। বর্তমানে এর সুফলও ভোগ করছেন রাজধানীবাসী। এভাবে আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করলে দুই মেয়রের বাকি তিন বছরে ঢাকার চিত্র বদল যাবে বলে প্রত্যাশা নগরবাসীর।
দুই সিটি কর্পোরেশন বিভক্ত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ মে শপথ গ্রহণ করেন সাঈদ খোকন ও আনিসুল হক। এরপরের দিনই সাদামাটাভাবে নগরভবনে প্রবেশ করেন আনিসুল হক। একদিন পর দায়িত্ব নেন সাঈদ খোকন। দায়িত্ব নিয়েই দুই মেয়র কর্পোরেশনের কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোন অবস্থান নেন। বেশ কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও এলোপাতাড়ি বদলি করতে থাকেন। ফলে শৃঙ্খলা ফেরে দুই সিটি কর্পোরেশনে।
বর্জ্যে ভাগাড়ে পরিণত হওয়া নগরীকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় দৃষ্টি দেন দুই মেয়র। সড়কের পাশে স্থাপন করা হয় প্রায় ১০ হাজার মিনি ডাস্টবিন। এছাড়া সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপন করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। উত্তর সিটি প্রায় অর্ধশত এসটিএস স্থাপন করতে পারলেও দক্ষিণ করতে পেরেছে মাত্র দুটি। গত বছরের জুনের দিকে কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার স্থানান্তর করার আশ্বাস দেন আনিসুল হক। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এই বাজারটি সরিয়ে নিতে এরই মধ্যে মহাখালী, আমিনবাজার ও যাত্রাবাড়িতে নতুন মার্কেট নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।
এদিকে নগরবাসীর যাতায়াত সমস্যা সমাধানে গত বছরের মার্চের মধ্যে তিন হাজার পাবলিক বাস চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন আনিসুল হক। কিন্তু এখনও এই উদ্যোগটির কাজই শুরু করতে পারেননি। অবশ্য অন্য একটি প্রকল্পে ‘ঢাকার চাকা’ নামে বনানী থেকে গুলশান রুটে একটি পাবলিক বাস চালু হয়েছে। এছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে বর্তমানে রাস্তায় চলছে এমন ১৯০টি বাস কোম্পানিকে পাঁচটি কোম্পানিতে নামিয়ে আনারও কোনো অগ্রগতি নেই।
অপরদিকে, গুলিস্তানসহ কিছু এলাকার ফুটপাত আংশিক মুক্ত হলেও শহরজুড়ে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ে যানজট সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না। শপিং মল, সুপার মার্কেট ও সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের সামনে এলোমেলো গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে পারেননি কোনো মেয়রই। অবৈধ দখলে বিলিনের পথে রাজধানীর খেলার মাঠ আর পার্ক উদ্ধারে এখনও কোনো উদ্যোগই নিতে পারেননি তারা। তবে, জল-সবুজে ঢাকা নামে একটি প্রকল্পের মাধম্যে দক্ষিণ সিটি এলাকার ৩০টির বেশি খেলার মাঠ ও পার্ককে আন্তর্জাতিক মানে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মিরপুর, তেজগাঁও, খিলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, মগবাজারসহ বেশকিছু এলাকায় ভাঙা রাস্তা দেখা যায়। এসব এলাকার ফুটপাতেও অবৈধ স্থাপনা থাকার কারণে সাধারণ মানুষের চলচলে বিঘ্ন ঘটছে। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার ইসলামবাগ, যাত্রাবাড়ি, পোস্তগোলা, মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, মীরহাজীরবাগসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তা-ঘাট খানাখন্দে ভরে আছে।
চলতি অর্থবছরসহ দুই বছরে রাজধানীর মশক নিধনের জন্য ৫১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি নগরবাসী। তবে, চলমান বেশকিছু কার্যক্রম শেষ হলে উন্নয়নের সুফল নগরবাসী প্রত্যক্ষ করবে বলে জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশন সংশ্লিষ্টরা।
দৃশ্যমান উন্নতি : উত্তরা, গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার সড়ক, ফুটপাত ও ড্রেনের টেকসই উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজ দৃশ্যমান। এসব এলাকার প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের দিকে রয়েছে। দীর্ঘদিন উন্নয়ন কাজের ভোগান্তি পোহালেও এখন সুফল পেতে শুরু করেছেন নগরবাসী। এছাড়াও সিসিটিভ, এলইডি সেবা ও ই-টেন্ডারিং দুর্নীতি মুক্ত ও নাগরিকের নিরাপত্তায় তাদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে। এসটিএস নির্মাণ, সড়কে আরামদায়ক গাড়ি, রিকশা নিয়ন্ত্রণ, ফুটপাত উন্নয়নসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজ উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
গত দুই বছরে ডিএনসিসি মেয়র তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড অপসারণ, মোনায়েম খানের পরিবারের দখল থেকে সড়ক অবমুক্তকরণ, গুলশান লেকপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, গাবতলী এলাকার সড়ক অবমুক্তকরণ, গুলশান, উত্তরা ও মিরপুর এলাকার অনেক সড়ক ও ফুটপাত দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করে সাধারণের চলাচলে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
অপরদিকে ডিএসসিসিও সড়ক, ফুটপাত, ড্রেনেজ, পাবলিক টয়লেট, খেলার মাঠ, পার্ক, ডিজিলাইজেশনের অনেক কাজ করেছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে ফাঁকি ঠেকাতে ডিজিটাল অ্যাটেন্ডেন্ট নিশ্চিত করা হয়েছে। অবহেলিত কামরাঙ্গীরচর ও নতুন যুক্ত হওয়া চার ইউনিয়নের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। খাল ও বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধার শুরু হয়েছে। সড়কে ১৮ হাজার ৬৮৭টি এলইডি বাতি নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে।
তাছাড়া মিডওয়েনে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ চলছে। শান্তিনগর এলাকার জলাবদ্ধতা ৯০ শতাংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। পুরো ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনসহ উন্নয়নে ৩৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। দুই হাজার ৪২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রযেছে। জানা গেছে, অধিকাংশ কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যেই শেষ হচ্ছে।
ডিএসসিসি মেয়রের পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গুদাম অপসারণ, মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-মিনিবাস অপসারণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, সিসিটিভি স্থাপন, গুলিস্তান ও নিউমার্কেট এলাকার হকার উচ্ছেদ ও তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশ পাঠানোসহ বেশ কিছু কাজে নগরবাসীর দৃষ্টি কেড়েছে।
দুই সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন কাজ দৃশ্যমান হলেও মশা, যানজট ও জলাবদ্ধতা সমাধানে উল্লেখযোগ্য সফলতা আসেনি। নগরজুড়ে এখনও মশার উপদ্রব রয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। যানজট যেন নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। তবে এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে দুই মেয়রের উদ্যোগ রয়েছে বলে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকর্মীদের জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে ৩৩৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে যাত্রাবাড়ি থেকে জয়কালী মন্দির পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ, ৫১ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রধান সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোল্ড রি-সাইক্লিং প্ল্যান্ট ও ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ, ২৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে কামরাঙ্গীরচরের ফুটপাত ও নর্দমা নির্মাণসহ রাস্তা পুনর্নির্মাণ, ২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ব্যয়ে সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি ও দয়াগঞ্জ এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ; ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যানবাহন, যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ, ১৯০ কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা আরবান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়ন। উন্নয়ন এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। আগামী তিন বছরে স্মার্ট শহর হবে আমাদের ঢাকা।
তবে ব্যক্তিগত কাজে উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক দেশের বাইরে থাকায় তার কোনো বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।