২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৮:৩১

পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে, তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খোলা

নীলফামারী প্রতিনিধি : একটানা ভারী বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৬টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানির প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের (জলকপাট) সবগুলোই খুলে রাখা হয়েছে। এছাড়া তিস্তা বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।

এদিকে ঢলের পানিতে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকার প্রায় ১৫টি চর ও চরগ্রাম হাঁটু থেকে কোমর সমান পানিতে তলিয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছেন।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে তিস্তার পানি শুক্রবার (১২ জুলাই) সন্ধ্যায় বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলো। তবে তিস্তা পাড়ের মানুষজন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওই হিসাব মানতে নারাজ। এলাকাবাসীর দাবি, পানি প্রবাহের মাত্রা অনেক বেশি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড সঠিক হিসাব রাখছে না।

উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, গত দুই দিনের বন্যার চেয়ে শুক্রবার উজানের ঢলে পানির গতিবেগ অনেক বেশি ছিল। ফলে এলাকার অনেক উঁচু স্থানেও নদীর পানি প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে এলাকার এক হাজার ১৪০ পরিবারের বসত বাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এলাকার ঝাড়শিঙ্গেরশ্বর মৌজাটি তলিয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার মাটির রাস্তাগুলো। রাস্তার ওপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ায় এলাকাবাসী বালির বস্তা দিয়ে পানি ঠেকানোর চেষ্টা করছে।.

পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংশ্বর চরের বাসিন্দা বানভাসী হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘গত তিনদিন ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে পানিবন্দি হয়ে আছি। চুলা জ্বালানোর কোনও উপায় না পেয়ে শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছি। গবাদি পশুসহ অনেক কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। বানভাসীদের জন্য সরকারি ত্রাণ এখনও বন্টন করা হয়নি।’

ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান জানান, ছাতুনামার চর, ফরেস্টের চর, সোনাখুলীর চর ও ভেন্ডাবাড়ি চরে দেড় হাজার পরিবারের বসতবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। দক্ষিণ সোনাখুলী এলাকায় তিস্তা নদীর ডান তীরের প্রধান বাঁধের কাছেই ইউনিয়ন পরিষদের তৈরি করা মাটির বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁধের ওপর দিয়ে তিস্তা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় দক্ষিণ সোনাখুলী কুঠিপাড়া গ্রামের ঘরবাড়ি ও আবাদী জমিগুলো তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এই বাঁধটি ভেঙে গেলে এলাকাটি পুরোপুরি তলিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  ইতোমধ্যে আমনের বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

উপজেলার খালিশা চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকার জানান, পূর্ব বাইশ পুকুর ও ছোটখাতা মৌজার পাঁচ শতাধিক বসতঘরের ওপর দিয়ে বন্যার পানি বয়ে যাচ্ছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, তার এলাকার দক্ষিণ খড়িবাড়ি ও পূর্ব খড়িবাড়ি, একতার চর, টাবুর চর মৌজায় তিস্তার বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। ইতোমধ্যে দুই হাজারেরও বেশি পরিবারের বসতবাড়িতে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শৌলমারী বানপাড়ায় ডানতীর গ্রাম রক্ষা বাধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জানান, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবেই আতঙ্কে আছি।  এই বাঁধ ভেঙে শুধু বানপাড়ায় নয়, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের ২০ হাজারেরও বেশি পরিবারের ঘরবাড়ি তিস্তা নদীতে পানিতে তলিয়ে যাবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ‘বানপাড়া বাঁধ ৬০ মিটার পর্যন্ত ভাঙন পাওয়া গেছে। আমরা ১২০ মিটার পর্যন্ত এই ভাঙন রোধের চেষ্টা করছি। তবে এ বাঁধটি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এর কাজ শুরু করা হবে।’

অপরদিকে, ডিমলা উপজেলার চরখড়িবাড়ি এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধটি তিস্তার পানি তোড়ে ভেঙে গিয়ে এলাকার দুই হাজার পরিবার নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, ‘উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের কারণে আমরা সর্তকাবস্থায় রয়েছি। শনিবার (১৩ জুলাই) সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বেড়ে বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যারাজের সবকটি স্লুইস গেট (৪৪টি)  খুলে রাখা হয়েছে।’

ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুন নাহার মুন বলেন, ‘কিছু মানুষজন নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। আর কিছু পানিবন্দি অবস্থায় বাড়িতে রয়েছে। তবে বন্যা কবলিত এলাকায় এখনও রেড এলার্ট জারি করা হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বানভাসীদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রয়েছে।’

নীলফামারী জেলা ত্রান ও দুযোগ কর্মকর্তা এসএ হায়াত জানা, শুক্রবার (১২ জুলাই) বিকালে ডিমলা উপজেলায় ৫০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আজ শনিবার জেলা পর্যায়ে বৈঠকের পর কতটুটু বরাদ্দ বানভাসীদের দেওয়া হবে সেটা পরে জানানো হবে।

প্রকাশ :জুলাই ১৩, ২০১৯ ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ