২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ভোর ৫:২৮

প্রতিপক্ষ নয় প্রতিদ্বন্দ্বী

নির্বাচনী উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচন হবে অথচ সেখানে তাপ-উত্তাপ থাকবে না! তা কী করে হয়? বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে সব সময় এই উত্তাপ ছিল। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা ঘিরে এই উত্তাপ। তবে তার তীব্রতা কম হলেই ভাল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক কারণেই ব্যতিক্রমী। তাই এবারের নির্বাচন নিয়ে মানুষ একটু ভিন্ন কিছু আশা করে। প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই থাকবে সেই ভিন্নতার ছাপ।

কিন্তু ভিন্নতা যদি রুপ নেয় সহিংসতায় তাহলে বিপদ। যা বাংলাদেশের মানুষ আর দেখতে চায় না। বাংলাদেশ আজ উন্নতির যে মহাসড়কে পা রেখেছে, তার পেছেন বড় একটা কারণ, দশম নির্বাচনের পরবর্তী চার বছর সময়ে দেশে হরতাল-অবরোধ-ভাঙচুর-অগ্নিসন্ত্রাস হয়নি। মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। দেশের উন্নয়ন আর অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। যার কারণে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নটা আজ দৃশ্যমান।

নির্বাচন কমিশন যদি সংশয়মুক্ত চিত্তে কাজ করে, তাদের মনে যদি কোন ভয় না থাকে; তাহলে একটা ভাল নির্বাচন আশা করা মোটেও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশ, নির্বাচন এলে কেন সংশয়-সন্দেহ নিয়ে বিশ্বের সামনে দাঁড়াবে! বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের মডেল। তাহলে সেই বাংলাদেশ কেন, নির্বাচনের মডেল হতে পারবে না?

রাজনীতিবিদরা পরিকল্পনা করবেন দেশ, সমাজকে বদলানোর। তার পেছনে মেধা-শ্রম থাকে সাধারণ মানুষের। তার জন্য দরকার পরিবেশের। সেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কোন রকম বিঘ্ন ঘটবে না নির্বাচনকে ঘিরে- তেমনটা প্রত্যাশা করে সাধারণ মানুষ। তারা ভোট দিতে চান। ভোটাররাই নির্বাচনের অন্যতম অংশীজন।

সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে এটা ভাল খবর। তবে সে কারণে স্বস্তির ঢেঁকুর তোলার কোন কারণ নেই। সবার অংশগ্রহণে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জনগণ যদি নির্ভয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং তাদের ভোটের প্রতিফলনের মধ্যে দিয়ে যদি সরকার গঠিত হয়, তখনই বলা যাবে, দেশে একটি সুন্দর নির্বাচন হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আর একটা বিষয় হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন।

প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে প্রতিপক্ষ ভাবলে বিপদ। প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবাই শ্রেয়। প্রতিপক্ষ ভাবলে হামলা-মামলা-রক্তারক্তি বেড়ে যায়। রাজনৈতিক সৌজন্য, শিষ্টাচার এগুলো হারিয়ে যায়। রাজনীতিবিদদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়লে তা সংক্রমাতি হয় তাদের সমর্থক, কর্মীদের ভেতর। যা সংক্রামিত হতে শুরু করেছে। অন্তত গণমাধ্যমে সে রকম খবর দেখা যাচ্ছে। আর সেই খবর দেখে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন তাঁরা বিব্রত! নির্বাচন কমিশন বিব্রত হলে উদ্বেগ বাড়ে সাধারণ মানুষের মনে। সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার দায়িত্ব নির্বাচনের আগে পরে নির্বাচন কমিশনেরই। তাদের মেরুদণ্ডটা সোজা দেখতে চায় সাধারণ মানুষ।

প্রধানমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেছেন; তিনি প্রমাণ করে দেখাতে চান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখতে দলীয় সরকারের অধীনেও একটা অবাধ-সুষ্ঠু -নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সেই চ্যালেঞ্জে তিন উতরে যেতে চান। তাঁকে সাহায্য করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তা, কর্মচারী সবার। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথা শোনার পর অনেকে উদ্বেগের অনেক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন।

সেই উদ্বেগ কখনো সূক্ষ্মতর। কখনো তীব্রতর। তবে সূক্ষ্মতর বা তীব্রতর কোন বিষয় নয়। বিষয়টা হচ্ছে উদ্বেগের বিষয় হবে কেন নির্বাচন? উত্তরটাও খুব ছোট। আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতি। আমরা সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি যেখানে দাঁড়িয়ে সাধারণ জনগণ ভাবতে পারে; নির্বাচন মানে পাঁচ বৎসর পর সত্যি এক ভোট উৎসব। জনমনে সে কারণে ভোটকে ঘিরে সংশয়-শংকা জন্ম নেয়।

নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে মেরুদণ্ড সোজা করে কাজ করে, তাহলে সেই সব শংকা-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অনেক কিছুই উবে যাবে। নির্বাচন কমিশনের কাজটাও এবার অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। তারা নিজেরা প্রমাণ করার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁদের অধীনে একটা সুন্দর নির্বাচন করা সম্ভব। তারা সেটা করতে পারেন। মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারানো পাপ। নির্বাচন কমিশনের ওপর থেকেও আমরা বিশ্বাস এবং আস্থা কোনটাই হারাতে চাই না।

বাংলাদেশের মানুষের আশায় বুক বেঁধেছে; এবার একটা ভাল নির্বাচন হবে। মোটাদাগে ভাল মানে অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন। মানুষের মনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-শংকা -সংশয় দূর করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তারা সেটা করতে সক্ষম। সেই সক্ষমতা তাঁদের আছে। তবে শুধু বিব্রত অবস্থায় দেখতে চায় না মানুষ নির্বাচন কমিশনারদের। তাদের সক্ষমতাটাই আমরা দেখার প্রত্যাশায় আছি। আপাত আমাদের সম্বল শুধু আশা।

আশার মাত্রাটা আরো একটু বেশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। তারা সহনশীলতা দেখাবেন। ভোট প্রার্থনা মানে মিছিল-মিটিং নয়। সমর্থকদের নিয়ে সভা-সমাবেশ নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণায় হামলা নয়। নতুন কিছু ভাবতে হবে রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রার্থীকে। সেটা সবসময় একেবারে জনমোহিনী হতে হবে তাও নয়। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির প্রতি সৎ থাকলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় থাকে না। জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার জন্ম হয় না।

তবে নির্বাচন কমিশন যদি সংশয়মুক্ত চিত্তে কাজ করে, তাদের মনে যদি কোন ভয় না থাকে; তাহলে একটা ভাল নির্বাচন আশা করা মোটেও বাড়াবাড়ি কিছু নয়। সাতচল্লিশ বছরের বাংলাদেশ, নির্বাচন এলে কেন সংশয়-সন্দেহ নিয়ে বিশ্বের সামনে দাঁড়াবে! বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের মডেল। তাহলে সেই বাংলাদেশ কেন, নির্বাচনের মডেল হতে পারবে না?

আজ মহান বিজয় দিবস। সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

প্রকাশ :ডিসেম্বর ১৬, ২০১৮ ৩:৫৩ অপরাহ্ণ