ডেঙ্গুজ্বর তেমন মারাত্মক কোনো রোগ নয়। তবে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রাণঘাতী হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মত চিকিৎসা নিলে প্রাণহানির আশঙ্কা ১% এরও কম। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
জ্বর কমে গেলে কি বিপদ কেটে গেল: ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত ৫-৬ দিন থাকে এবং তারপর সম্পূর্ণ ভালো হয়ে। জ্বর কমে গেলে অনেক রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করেন, রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেছে। কিন্তু ডেঙ্গুজ্বরে মারাত্মক সমস্যা হবার সময় আসলে এটাই। এসময়ই প্লাটিলেট কমে যায় এবং রক্তক্ষরণসহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। জ্বর কমে যাবার পরবর্তী সময়টাকে তাই বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’। এ সময় সচেতন থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি।
কি পরীক্ষা কখন করা উচিত :
সাধারণত বেশি টেস্ট করার প্রয়োজন হয় না। সিবিসি এবং প্লাটিলেট কাউন্ট করলেই যথেষ্ট। তবে জ্বরের একদম শুরুতে রক্ত পরীক্ষা করালে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকবে এবং তা রোগ নির্ণয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। রোগী এমনকি ডাক্তারও মনে করতে পারেন, রিপোর্ট ভালো আছে, তাই আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। প্লাটিলেট কাউন্ট ৪ বা ৫ দিন পর কমতে শুরু করে, তাই জ্বর শুরুর ৪-৫ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। আবার অনেকেই দিনে দুই তিনবার, এমনকি একই সঙ্গে একাধিক ল্যাবরেটরি থেকে প্লাটিলেট কাউন্ট করে থাকেন, যা অপ্রয়োজনীয়। ১-২ দিনের জ্বরে ডেঙ্গু এনএস-১ এন্টিজেন এবং ৪ থেকে ৬ দিন পর এন্টি ডেঙ্গু এন্টিবডি করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাগুলো রোগ শনাক্তকরণে সাহায্য করলেও চিকিৎসায় ভূমিকা নেই।
রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তা আছে কি : ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হলেই রোগী এবং চিকিৎসক উভয়েই রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ যদি রক্তক্ষরণ না হয় এবং রোগীর রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক থাকে, তবে রক্ত পরিসঞ্চালন করার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্লাটিলেট কি দিতেই হবে : ডেঙ্গু জ্বরের ৪ বা ৫ দিন পরে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ২-৩ দিন পর তা বাড়তে শুরু করে কোন চিকিৎসা ছাড়াই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় প্লাটিলেট কমে গেলেই রোগী এবং চিকিৎসক প্লাটিলেট পরিসঞ্চালনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। আবার, তাড়াহুড়ো করে প্লাটিলেট এমনকি রক্ত পরিসঞ্চালন করলে হেপাটাইটিস বি,সি, এইচআইভি ইত্যাদি সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
একবার ডেঙ্গু হলে আর কি হয় না : এ ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। কেননা, ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি ভিন্ন প্রজাতি বা সেরোটাইপ আছে, তাই চারবার ডেঙ্গু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ডেঙ্গু ভাইরাসের যে কোনো একটি প্রজাতি দ্বারা একবার আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ওঠার পর ভবিষ্যতে সেই সেরোটাইপ দ্বারা আর আক্রান্ত হয় না। কারণ শুধু সেই সেরোটাইপটিতে রোগীর আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। কিন্তু বাকি ৩টি প্রজাতি দ্বারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ঠিকই রয়ে যায়। তবে কেউ যদি পৃথকভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি প্রজাতি দ্বারা জীবনে চারবার ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত
হয়ে থাকেন, তাহলে বাকি জীবনে আর ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
ডেঙ্গু কি ছোঁয়াচে রোগ : ডেঙ্গু কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। কাজেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে, একই বিছানায় ঘুমালে, একই তোয়ালে, একই গ্লাস কিংবা প্লেট ব্যবহার করলে অন্যদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। ডেঙ্গুজ্বরে রোগীর সঙ্গে সামাজিক মেলামেশায় বাধা নেই।
অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে কি : ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ, এতে অ্যান্টিবায়ো-টিকের কোনো ভূমিকা নেই। তবে ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগও থাকতে পারে, তখন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। অনেকে মনে করেন ডেঙ্গুতে অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতি করে এবং তা পরিহার করতে হবে, যা ভুল ধারণা। প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে কোনো ক্ষতি হবে না।
গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কি করণীয়: এক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। কারণ, মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই এসময়টা ঝুঁকিপূর্ণ। উপসংহারে বলা যায়, ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই অবহেলা না করে একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি সম্ভব।