প্রভাষ আমিন:
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের বর্ষপূর্তি ছিল, সঙ্কটের নয়। রোহিঙ্গা সঙ্কট অনেক পুরনো। আগেও অনেকবার রাখাইনে আগুন দিয়ে রোহিঙ্গাদের খেদিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে মিয়ানমার। তবে সেগুলো ছিল সংখ্যায় অল্প, অনেকটা পরীক্ষামূলক। মিয়ানমার যেন বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছিল বা বাংলাদেশের গা সইয়ে নিতে চাইছিল।
অল্প অল্প করে সওয়াতে সওয়াতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট চূড়ান্ত ধাক্কাটা দেয় মিয়ামনমার। নির্বিচার গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ সব মিলিয়ে এই ধাক্কাটা ছিল রোহিঙ্গা জাতি নিশ্চিহ্ন করার এক নিষ্ঠুর পরিকল্পনার নিষ্ঠুরতম বাস্তবায়ন। এই ধাক্বায় রাখাইন রাজ্য প্রায় খালি করে ফেলেছে মিয়ানমার।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়। এখন চলছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। আমার আশঙ্কা রোহিঙ্গাদের ফেরাতেও আমাদের তেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হতে পারে। তবে সেটা পঞ্চবার্ষিকী হবে না, হতে পারে পঞ্চাশবার্ষিকী পরিকল্পনা।
শুধু রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করেই বসে থাকেনি মিয়ানমার। আগুন দিয়ে খালি বাড়িঘর পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন দেখলে আর বোঝার উপায় নেই সেখানে একসময় ব্যস্ত জনপদ ছিল। এটাকেই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য মনে করছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে গণহত্যা আর জাতিগত নিধনের অভিযোগ যে একটা দেশের জন্য কত বড় গ্লানির, কত বড় লজ্জার; তা বোঝার মত মানবিক হৃদয় নোবেল শান্তি পুরস্কারের কলঙ্ক হয়ে থাকা অং সান সু চি বা তার সেনাবাহিনীর নেই।
কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেই ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা স্থায়ী ও সম্মানজনক সমাধানের সূত্র। কিন্তু মিয়ানমার তো সেটা চায়নি। তাই কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই হামলা চালায় সেনাবাহিনী। আরসা নামে একটি রহস্যজনক সংগঠনের সেনা ক্যাম্পে হামলাকে অজুহাত করেই রোহিঙ্গা জাতি নির্মূলে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। আরসাকে রহস্যজনক বলছি, কারণ আগেও এই সংগঠনের নাম কেউ শোনেনি, এখনও তাদের কোনো তৎপরতা নেই।
এখন সব দেখেশুনে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে, আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীরই সৃষ্টি। তারা রোহিঙ্গা নিধনের যুক্তি তৈরি করতেই আরসাকে মাঠে নামিয়েছিল। আমার খারাপ লাগছে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের জন্য। তিনি রাখাইনে যে শান্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা অপূর্ণ রেখেই তাকে চলে যেতে হলো। স্বপ্ন তো পূরণ হয়ইনি বরং তাঁর কমিশনের রিপোর্টের কারণেই রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে মরতে হলো, বাস্তুচ্যুত হতে হলো- এমন অনুশোচনা ছিল কিনা জানি না।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপে এখন পিষ্ট বাংলাদেশ। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ তাদের ঢুকতে দিল কেন? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তারা ফিরেও এসেছিল। যে রাষ্ট্রের জন্মের সাথে শরণার্থী সমস্যার যোগ, সে রাষ্ট্র শরণার্থীদের ব্যাপারে নিষ্ঠুর হতে পারে না। তাই বাংলাদেশ তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিল রোহিঙ্গাদের জন্য। তাই তো মিয়ানমার যখন সারাবিশ্বে অমানবিকতার জন্য ঘৃণিত, তখন বাংলাদেশ মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু সেই মানবিক আশ্রয় এখন বাংলাদেশের জন্য পারমাণবিক বোমার মত ঝুঁকি তৈরি করছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পের নাম এখন কুতুপালং। ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর চাপ তো আছেই, রোহিঙ্গারা তৈরি করছে বহুমাত্রিক সমস্যা। তাদের খাওয়ানো, পড়ানো তো আছেই; আছে আইন-শৃঙ্খলা ঝুঁকি, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, জঙ্গী ঝুঁকি সবই ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। পরিবেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। বদলে যাচ্ছে টেকনাফ তথা কক্সবাজারে আর্থ-সামাজিক চিত্র, বাংলাদেশীরাই এখন টেকনাফে সংখ্যালঘু।
রোহিঙ্গা সঙ্কট বিশ্বের সব মানবিক মানুষকেই নাড়া দিয়েছে। বছরজুড়ে বাংলাদেশ অনেক প্রশংসা পেয়েছে। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রশংসায় তো বাংলাদেশের পেট ভরবে না। বাংলাদেশের চাই সমস্যার স্থায়ী সমাধান। সে ক্ষেত্রে গত এক বছরে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। না হওয়ার দায় পুরোটাই মিয়ানমারের। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েই তারা নিশ্চিন্ত।
বিশ্বজুড়ে নিন্দার পরও অং সান সু চির কোনো বিকার নেই। বরং তিনি প্রত্যাবাসনের বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করছেন। বাংলাদেশ তো রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু মিয়ানমার তাতে ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি। গত একবছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কিছু যে হবে না, সে আশঙ্কা আমি আগেই করেছিলাম। তবে আমার ধারণা ছিল আন্তর্জাতিক মহলের চোখে ধুলো দিতে হলেও মিয়ানমার কিছু রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে। ধরুন মিয়ানমার যদি একলাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতো, তাহলেও কিন্তু ধন্য ধন্য পড়ে যেতো। তারপরও কিন্তু বাংলাদেশে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা থেকে যেতো।
এক লাখ ফিরিয়ে নিলেই কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু মিয়ানমার আমার ভাবনার চেয়েও খারাপ। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েই নিশ্চিন্ত, নির্ভার। তারা যেন কানে তুলো গুজে রেখেছে। তাদের চক্ষুলজ্জা বলতেও কিছু নেই। একবছরে এত কথার পরও তারা একটা প্রতীকি পুনর্বাসনের উদ্যোগও নেয়নি।
একাত্তরে বিজয় অর্জনের পর ভারত থেকে বাংলাদেশী শরণার্থীরা ফিরে এসেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা কবে ফিরে যেতে পারবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা কিন্তু তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে চায়। বিতাড়নের বর্ষপূর্তিতে প্রত্যাবাসনের দাবিতে তারা বিক্ষোভ করেছে।
কারো হয়তো ফেলে বাড়ির আতা গাছটি টানছে, কেউ হয়তো উদাস দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে থাকতে মন কাঁদে। কে হায় ভিনদেশে ক্যাম্পে থাকতে মন চায়? কিন্তু সমস্যা হলো, ফিরে গেলেও রোহিঙ্গারা তাদের ভূমি ফিরে পাবে না। সেখানেও তাদের কোনো না কোনো ক্যাম্পেই থাকতে হবে। তাই তারা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে নাও চাইতে পারে। আর না চাইলে তাদের ফেরানো অসম্ভব।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হলে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা করে লাভ হবে না। সবাইকে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে। সে চাপ শুধু নিন্দা বা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। অর্থনৈতিক অবরোধের মত কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। পেটে লাথি বা পকেটে টান পড়লেই শুধু তারা বুঝবে। বিশ্বকেও বুঝতে হবে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিলেও এই সঙ্কটে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই। আর এ সঙ্কট শুধু বাংলাদেশের নয়, এটা বিশ্ব মানবতার সঙ্কট।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়। এখন চলছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। আমার আশঙ্কা রোহিঙ্গাদের ফেরাতেও আমাদের তেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হতে পারে। তবে সেটা পঞ্চবার্ষিকী হবে না, হতে পারে পঞ্চাশবার্ষিকী পরিকল্পনা। তাও একটাতে হবে না, একাধিক লাগতে পারে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও কিন্তু আমরা আটকেপড়া পাকিস্তানীদের ফিরিয়ে দিতে পারিনি।
যত সময়ই লাগুক, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর সতর্ক থাকতে হবে, রোহিঙ্গারা যেন কোনোভাবেই মূলধারায় মিশে যেতে না পারে। বাংলাদেশ মানবিক রাষ্ট্র। কিন্তু নিজেদের ক্ষতি করে মানবতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।