শিল্প ও বাণিজ্য ডেস্ক :
ঘুরে দাড়াচ্ছে রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প। পুরনো পেশায় ফিরে আসছেন এ শিল্পের কারিগররা। চিরায়ত বাংলার নয়নাভিরাম নকশার শতরঞ্জির চাহিদাও বাড়ছে দেশজুড়ে। এখন সমাদৃত হচ্ছে বিদেশেও। শ্রমঘন এবং স্বল্প পুঁজির ব্যবসা হওয়ায় অনেকে ঝুকছেন এ শিল্পে। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্প আরও বিকশিত হতো বলে মত দিয়েছেন এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
উত্তর জনপদের জেলা রংপুরের অজপাড়াগাঁয়ের হস্তশিল্প শতরঞ্জি।জেলা শহর থেকে পশ্চিমে সেনানিবাসের পেছনে ঘাঘট নদীর কোলঘেঁষে বিশাল এক গ্রামের নাম নিসবেতগঞ্জ। এ গ্রামের প্রায় আড়াইশ পরিবার উল ও সুতার শতরঞ্জি বুনে আজ স্বনির্ভর হয়েছেন। তাদের বোনা শতরঞ্জি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, গ্রামটির কিছু মানুষ ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে পাটের সুতার শতরঞ্জি বানানো শুরু করেন। পরে ব্রিটিশ আমলে ওই গ্রামের একটি পাড়ার নামই হয়ে যায় শতরঞ্জিপাড়া। এখন সেটির নাম হয়েছে শতরঞ্জি পল্লী। রংপুর জেলার তাঁতিরা একধরনের মোটা কাপড় তৈরি করে যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি বা ডুরি মূলত এক প্রকার কার্পেট, একসময় সমাজের অভিজাত শ্রেণীর গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হতো।
বর্তমান আধুনিক সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে। শতরঞ্জি আগে শুধু ঘরের মেঝেতে বিছানোর জন্যই তৈরি হতো। সময়ের বিবর্তনে একই বুননে শতরঞ্জির ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, কুশন কভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশও তৈরি হচ্ছে। শতরঞ্জিতে বিভিন্ন রঙের সমন্বয় ঘটিয়ে ডিজাইন করা হয়। ৬ থেকে ৯টি রঙের ৪০-৫০টি ডিজাইনের শতরঞ্জি বাজারে পাওয়া যায়। পাশাপাশি ইচ্ছা অনুযায়ী নতুন করে বা নিজের পছন্দের নকশা অনুযায়ী ফল, ফুল, কার্টুনের পায়ের ছাপ এসব আকারের শতরঞ্জিও পাবেন। শতরঞ্জির দাম নির্ধারণ করা হয় স্কয়ার ফিট হিসাবে।
প্রতি স্কয়ার ফিট ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয়। রংপুরে রয়েছে শতরঞ্জির প্রায় ৩০টি দোকান। এ পেশার সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। এই শিল্পকে ঘিরে শহরের উপকণ্ঠে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি পল্লী। শতরঞ্জি পল্লীতে দেখা গেল শতরঞ্জি বুননে ব্যস্ত আছেন নারী-পুরুষ সবাই। কর্মী সালেহা বেগম মুক্তা (৩৫) বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কাজ করছি। যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালাই এবং ছেলে মেয়েদেরও পড়াশুনা খরচ দেই।
রংপুর কারমাইকেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষেও ছাত্রী ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, দুই বছর থেকে এই কাজের সঙ্গে জড়িত তিনি। পড়াশুনার ফাঁকে এ কাজে জড়িত বলে জানান তিনি।
রাশেদা বেগম, রাজিয়া সুলতানা (২৫), মাছুরা খাতুন (২২), আখিরা খাতুন (২৫)সহ আরও অনেকেই বললেন, হস্তজাত এই শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁদের জীবন-জীবিকা চলছে। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি বুনতে পারেন। প্রতি বর্গফুটে তাঁরা ১৫ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন।
১৯৯১ সালে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা ছোট্ট কারখানা ভাড়া নিয়ে ঝিমিয়ে পড়া শতরঞ্জি শিল্পকে জাগিয়ে তুলতে উদ্যোগ নেন রংপুরের কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম। তার কারখানায় শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল দিয়ে ব্যাপক পরিচিত ও ক্রেতাদের দৃষ্টি কাড়েন। এভাবে বাড়তে থাকে শতরঞ্জির চাহিদা। আর এখন এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ কাজ করছেন। তাঁরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। তৈরি করছেন নকশাখচিত শতরঞ্জি। এই শতরঞ্জি এখন বিশ্বের ৩৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। হস্তজাতশিল্প থেকে বছরে বৈদেশিক মদ্রা আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
বেসরকারি উদ্যোক্তা সফিকুল ইসলাম সেলিম জানান, শতরঞ্জি বিক্রির জন্য ব্যাপক প্রচারণায় নেমেছি। সাড়াও পেয়েছি আমরা। শতরঞ্জি বানিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্য মেলায় স্টল দেয়া হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রপ্তানির সুযোগ হয়।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী শতরঞ্জি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কারণ শিল্প এলাকায় অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকা, কারিগরি জ্ঞানের অভাব, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় তারা শতরঞ্জি কারখানা গড়ে তুলতে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। তাদের মতে, সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশীয় কাঁচামাল দিয়েই এ শিল্পের প্রসার সম্ভব।
জানতে চাইলে রংপুরে বাংলাদেশ ক্ষদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উপ-মহাব্যবস্থাপক খায়রুল আলম আল মাঝি বলেন, বিসিক তাঁতিদের ঋণ-সহায়তা দিয়ে থাকি আমরা। এছাড়াও প্রায় হাজার শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরও দেয়া হবে। স্বল্প সুদে তাঁতিদেরও ঋণ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ