বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক :
নিজ কক্ষপথে পৌঁছে গেছে স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। তবে এখনই আমরা নিয়ন্ত্রণ পাচ্ছি না। অরবিট স্লটে পুরোপুরি সেট করে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে পেতে অন্তত ২০ দিন লাগবে। এজন্য প্রস্তুত রয়েছে গাজীপুরে নির্মিত গ্রাউন্ড স্টেশন। এখন গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে স্যাটেলাইটের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। পথের মধ্যে এয়ার ট্রাফিকে গতি কিছুটা কমলেও মূল পথেই আছে এটি।
অনন্য এ অর্জনে উল্লসিত দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্যাটেলাইট উেক্ষপনের প্রক্রিয়ায় জড়িত সবাইকে অভিনন্দন জানান। শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে স্যাটেলাইট উেক্ষপনের পরপরই প্রধানমন্ত্রী টেলিফোন করেন তার ছেলে ও তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে। জয় মোবাইল ফোনে লাউড স্পিকার দিয়ে উপস্থিত সবার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীকে। ঐতিহাসিক এই অর্জনে কঠোর পরিশ্রম করায় সেখানে উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উেক্ষপণ উপলক্ষে উত্সব করবে সরকার। আজ রবিবার জানা যাবে কবে সেই উত্সব। রোজা শুরুর আগেই উত্সব করতে চান স্যাটেলাইট সংশ্লিষ্টরা। প্রধানমন্ত্রীর সময় পাওয়া গেলে মঙ্গলবারা বা বুধবারই হতে পারে সেই দিন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ গতকাল বলেন, ‘সবাই খুবই উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়ে যাওয়ায় সবাই খুব খুশি।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ পরিচালনায় নবগঠিত কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, স্যাটেলাইটটি বর্তমানে ইন্টারমেডিয়েট বা মধ্যবর্তী কক্ষপথে পৌঁছেছে এবং এটি উেক্ষপণ যান থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। তিনি জানান, প্রায় ৩৬ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নির্ধারিত অবস্থানে পৌঁছাবে।
এ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৯ থেকে ১৯ দিন। আশা করা হচ্ছে ১২ দিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কক্ষপথে তার জন্য নির্ধারিত স্থানে স্থাপিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালির ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে বাংলাদেশকে। এই তিনটি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকেই সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট পুরোপুরি স্থাপিত হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ শুরু হবে গাজীপুর ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে।
গাজীপুর ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র সূত্র জানায়, ফ্লোরিডায় স্পেসএক্সের লঞ্চিং স্টেশন থেকে উক্ষপণের ৩৩ মিনিটের মধ্যেই এটি ইন্টারমিডিয়েট কক্ষপথ বা জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার কক্ষপথে পৌঁছে যায়। উক্ষপণের যান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় ৪০ মিনিট পর প্রথম সংকেত পৌঁছে গাজীপুর ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে। সূত্রটি জানায়, গাজীপুর ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উপর ২৪ ঘন্টা নজর রাখা হচ্ছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ৩২ জন প্রকৌশলী এই পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন। তারাই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবেন। প্রস্তুত আছে রাঙামাটির বেতবুনিয়া উপগ্রহ কেন্দ্রও।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উেক্ষপণের সাফল্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে স্পেসএক্স। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মিশন সফল হওয়ার রোমাঞ্চিত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের কর্মকর্তারাও। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে নিয়ে উড়াল দেওয়া ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫ রকেট উেক্ষপণের স্টেজ ছিল দু’টি। নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে রকেটের স্টেজ-১ খুলে যায়। কাজ শুরু করে স্টেজ-২। এরপর সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে স্টেজ-১ এবং নেমে আসে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন শিপে। স্টেজ-২ পৌঁছে যায় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে। মহাশূন্যে ভাসতে থাকে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ স্যাটেলাইট।
বাংলাদেশ ও আশপাশের এলাকায় সেবা দিতে পারবে এ স্যাটেলাইট। বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের জলসীমা এর কিউ-ব্যান্ডের অধীনে থাকবে। এর সঙ্গে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় সেবা দিতে পারবে। এ ছাড়া ডিটিএইচ সেবা, ভিডিও ও ভিস্যাট সেবা দিতে পারবে দেশজুড়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ দিতে সক্ষম হবে। কমপক্ষে ১৫ বছর এ মিশন অব্যাহত থাকবে।
এই স্যাটেলাইটের সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয় দু’টিই করা যাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সমপ্রসারণ করা সম্ভব হবে। এবং দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইটকে কাজে লাগানো সম্ভব।
এখন দেশে প্রায় ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল সমপ্রচারে আছে। এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে একটি চ্যানেলের ভাড়া বাবদ গুনতে হয় তিন থেকে ছয় হাজার মার্কিন ডলার। সব মিলিয়ে স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে চ্যানেলগুলোর খরচ হয় ২০ লাখ ডলার বা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু হলে এ টাকা দেশেই থাকবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রানসপন্ডার অন্য দেশের কাছে ভাড়া দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ থাকবে। এই স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রানসপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিক্রির জন্য সরকারের গঠন করা বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিসিএসবি) লিমিটেড কাজ শুরু করেছে। যোগাযোগ হয়েছে আরো কয়েকটি দেশের সঙ্গেও।
এছাড়া দেশের ৭৫০ ইউনিয়নে এখন ফাইবার অপটিক ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। ইন্টারনেটবঞ্চিত এমন এলাকার মধ্যে রয়েছে পার্বত্য ও হাওর অঞ্চল। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। ঝড় বা বড় ধরনের দুর্যোগে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখতেও কার্যকর হবে এ স্যাটেলাইট। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোবাইল নেটওয়ার্ক অনেক সময় অচল হয়ে পড়ে। তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রাখা সম্ভব হবে।