নিজস্ব প্রতিবেদক:
আগামী বছরের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী বছর হওয়ায় অক্টোবরের মধ্যে এবার মুদ্রণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সে অনুযায়ী টেন্ডার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু কাগজের দাম নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে এ সংক্রান্ত দরপত্র চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। এসব কারণে যথাসময়ে প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের হাতে বই না পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আজ যারা এসএসসি পাস করছে, তাদের কলেজে ক্লাস শুরু হবে ১ জুলাই। হাতে প্রায় দু’মাস সময় থাকলেও তাদের বাংলা, ইংরেজি এবং বাংলা সহপাঠ বই মুদ্রণ কাজ শুরু হয়নি। বইয়ের দাম চাহিদা মতো নির্ধারণ না হওয়ায় এসব বই মুদ্রণ ও বাজারজাতের জন্য ডাকা টেন্ডার বর্জন করেছেন প্রকাশকরা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ের টেন্ডারে কী ঘটেছে, তা আমার জানা নেই। যদি কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, তবে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। সমস্যা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য বিনামূল্যের বই অক্টোবরের মধ্যে ছাপার কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে নেমেছি। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত কোনো জটিলতা নেই। যেসব কাজের টেন্ডার হয়েছে, সেগুলোর মূল্যায়ন পর্ব চলছে। কোনোটি মূল্যায়নে সমস্যা হলে সিদ্ধান্ত দেয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেয়া হবে। এরপরও কোনো কারণে যদি ছাপার কাজ শুরুতে বিলম্ব হয়, সেক্ষেত্রে সময় বাড়ানো হবে। প্রয়োজনে নভেম্বরে গড়াবে। কোনো সমস্যা দেখছি না।
আগামী বছরের জন্য সরকার প্রায় ৩৬ কোটি ৬ লাখ বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বই চারটি আলাদা টেন্ডারে ছাপানো হয়। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের একটি অংশের বইয়ের টেন্ডার হয়েছে। সেগুলোর মূল্যায়ন কাজ চলছে। এসব বইয়ের কাগজ সরকার দেয়, মুদ্রাকররা শুধু ছেপে দেয়। এ কারণে এ দুটি টেন্ডার নিয়ে কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। তবে কাগজ যে দরে কেনা হয়েছে, বাকি দুটি টেন্ডারের কাগজের দর এর চেয়ে কম ধরা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাকি দুটি টেন্ডারের একটি প্রাথমিকের বইয়ের। অপর টেন্ডারে মাধ্যমিকের মূল ১২টি বইসহ কারিগরি-মাদ্রাসা স্তরের বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে প্রাথমিকের টেন্ডার নিয়ে মহাজটিলতা তৈরি হয়েছে। মাধ্যমিকের টেন্ডার নিয়েও জটিলতা তৈরির আভাস পাওয়া গেছে। এ কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, এনসিটিবি যে দরে (প্রাক্কলন) প্রাথমিকের বইয়ের কাজ দিতে চায়, দরদাতারা তার চেয়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি দর হেঁকেছে। এ কারণে টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি কয়েকদফা বৈঠক করেও এ সংক্রান্ত কাজ শেষ করতে পারেনি।
শুধু তা-ই নয়, টেন্ডারের প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি নিয়ে কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। একটি অংশ আবার নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করার পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু এতে কমপক্ষে ২ মাস পিছিয়ে যেতে হবে। কেননা টেন্ডার আহ্বান করে ৪২ দিন সময় দিতে হয় দাখিলের জন্য। এছাড়া মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশ দিতে আরও প্রায় এক মাস সময় লেগে যায়। তাই এই আড়াই মাসের ক্ষতি ঠেকাতে আরেক অংশ পিপিআরের (সরকারি ক্রয় আইন) বিধান মেনে বিদ্যমান টেন্ডার স্থগিত রেখে নতুন করে দর প্রাক্কলন শেষে নিষ্পত্তির পক্ষে মত দেন।
কিন্তু এরপরও নতুন করে টেন্ডার ডাকার প্রস্তাব উঠলে এক সদস্য ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। এ অবস্থায় কমিটির সদস্যরা একমত না হওয়ায় সিদ্ধান্ত ছাড়াই মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হচ্ছে। অপরদিকে আগামীকাল মাধ্যমিকের দ্বিতীয় টেন্ডার উন্মুক্ত হওয়ার কথা আছে। কিন্তু দরদাতাদের একটি অংশ টেন্ডার দাখিল করবে না বলে এনসিটিবি এবং মুদ্রাকর সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। এর পেছনে দুটি কারণ জানা গেছে।
একটি অংশ হচ্ছে- গত বছরের বই ছাপানো বিলের ২০ শতাংশ এখন পর্যন্ত এনসিটিবি পরিশোধ করেনি। আরেকটি হচ্ছে, বইয়ের প্রাক্কলিত দর বৃদ্ধির দাবি। তবে এরপরও কেউ কেউ বেশি দরে টেন্ডার দাখিলের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই টেন্ডার নিয়েও জটিলতা তৈরি হতে পারে।এনসিটিবি এবং মুদ্রাকর সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত দুটি টেন্ডারের বইয়ের কাগজ মুদ্রাকররা কিনে বই ছেপে থাকেন। সে কারণে এই টেন্ডারের মোট দরের ৮৫ শতাংশই কাগজের দরের ওপর নির্ভর করে।
সামনে জাতীয় নির্বাচন, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর, স্থানীয় বাজারে কাগজ সংকট, কাগজের মণ্ডের দর বৃদ্ধির কারণে এবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দর অনেক বেশি। অপরদিকে নির্বাচনী বছর হওয়ায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় এবার কাজের চাপ বেশি। তাই বর্ধিত চাহিদার কারণে দরও বেশি হাঁকছেন তারা। সবমিলিয়ে সরকার যে দরে বই ছাপতে চায়, তার চেয়ে দরদাতারা টেন্ডারে বেশি দর হেঁকেছেন। এসব কারণেই টেন্ডার নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
মুদ্রাকরদের একটি অংশ বলছে, এনসিটিবির চারটি কাজের মধ্যে যে দুটি কাগজসহ টেন্ডার করে থাকে, সেগুলোর কাগজ গত বছরের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি দরে কিনেছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের কাগজের পুরত্ব ৬০ জিএসএম এবং উজ্জ্বলতা ৮০ শতাংশ। এই কাগজ কিনছে প্রতি টন ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ ১ হাজার টাকা করে।
অপরদিকে প্রাথমিকের বইয়ের কাগজের পুরত্ব হয় ৮০ জিএসএম এবং উজ্জ্বলতা হয় ৮৫ শতাংশ। সেই হিসাবে প্রাথমিকের কাগজের দাম বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এই বইয়ের প্রাক্কলন দর কমিয়ে প্রতি টন ৮২ হাজার টাকা করা হয়েছে। মূলত এ কারণে প্রাথমিকের বইয়ের দর বেশি হাঁকা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, শুধু কাগজ বা কাগজ তৈরির মণ্ডই নয়, মুদ্রণের প্লেট, কালি, গামসহ সব সামগ্রীর দাম বেড়েছে। এ কারণে দরদাতারা বেশি দামে বইয়ের কাজ নিতে চান। কিন্তু এনসিটিবি ভুতুড়ে প্রাক্কলন নির্ধারণ করেছে। এক্ষেত্রে তাদের আচরণও রহস্যজনক। কেননা অপেক্ষাকৃত নিুমানের কাগজ যে দরে তারা কিনছে, তার চেয়ে ভালো মানের কাগজের দাম ২৩ থেকে ২৯ হাজার টাকা কম প্রাক্কলন করেছে। আমরা বইয়ের কাজ করতে চাই। কিন্তু লোকসান দেয়ার জন্য কেউ কাজ নেবে না। তিনি মনে করেন, নির্বাচন প্রাক্কালে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেউ বইয়ের মতো স্পর্শকাতর জিনিস নিয়ে খেলা শুরু করেছে।
তিনটি বই মুদ্রণ ও বাজারজাতের টেন্ডারের জন্য ৯৩টি প্রতিষ্ঠান সিডিউল কিনেছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার টেন্ডার বক্স খুলে দেখা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠান সিডিউল জমা দেয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক্ষেত্রেও কাগজসহ মুদ্রণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বইয়ের দাম বাড়ানোর দাবি ছিল প্রকাশকদের। সে অনুযায়ী বাংলা ও সহপাঠের দাম বাড়ানো হয়। ইংরেজি বইয়ের দাম গত বছরের মতোই আছে। কিন্তু বর্ধিত দাম প্রত্যাশিত পর্যায়ের না হওয়ায় কেউ টেন্ডার জমা দেননি।
এ ব্যাপারে এই বইয়ের একজন প্রকাশক এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সাবেক সহসভাপতি শ্যামল পাল বলেন, কাগজসহ মুদ্রণ উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি গত বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিপরীত দিকে এনসিটিবি নামমাত্র হারে বইয়ের দাম বাড়িয়েছে। বিপরীত দিকে প্রচুর নকল বই বাজারে বিক্রি হয়। বাজারে এনসিটিবির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। নকল প্রতিরোধে এনসিটিবির কোনো মাথাব্যথাও নেই। তাই লাখ লাখ টাকা অগ্রিম রয়্যালটি দিয়ে এ বই বাজারজাতের কাজ নেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সে কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমি টেন্ডারে অংশ নিইনি।
উল্লেখ্য, গত বছর বাংলা বইয়ের দাম ছিল ১১৩ টাকা। এবার ধরা হয়েছে ১২১ টাকা। বাংলা সহপাঠের দাম গত বছর ছিল ৫৫ টাকা, এবার ধরা হয়েছে ৫৯ টাকা। ইংরেজি বইয়ের দাম গত বছরের মতোই ৮১ টাকা রাখা হয়েছে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি