বান্দরবান প্রতিনিধি:
ঘটনাটি ২০১৭ সালের ১৩ জুনের। এর আগে টানা চারদিন ধরে চলছিল প্রবল বর্ষণ। ওই দিন ভোর রাতে হঠাৎ করেই বান্দরবানের কালাঘাটায় কয়েক জায়গায় পাহাড় ধসে পড়ে ঢালে থাকা বসত বাড়ির ওপরে। এতে পাহাড়ের মাটি চাপায় মারা যান সাত জন।
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই ফের টানা বর্ষণের কারণে গত বছরের ২৩ জুলাই রুমা সড়কের দনিয়াল পাড়ায় রাস্তার ওপরে পাহাড় ধসে পড়ে। এখানে মাটি চাপা পড়ে নিখোঁজ হন পাঁচজন পথচারী। পরে এই পাঁচজনের লাশ পাওয়া যায় বান্দরবানের সাঙ্গু নদীসহ কয়েকটি ঝিড়ি ঝরনা থেকে। এত কিছুর পরেও এ জেলায় থেমে নেই পাহাড় কেটে বসতবাড়ি নির্মাণ। গত বছরের বর্ষা মৌসুম যেতে না যেতেই পাহাড় কেটে জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ নতুন বসতবাড়ি। সবগুলো ঘরের অবস্থান পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ ঢালে।
বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে জানা গেছে, বান্দরবান সদর উপজেলার কালাঘাটা,কাসেমপাড়া, ইসলামপুর, বনরূপা পাড়া, হাফেজঘোনা, বাসস্টেশন এলাকা, স্টেডিয়াম এলাকা, নোয়াপাড়া, কসাইপাড়া, লামা উপজেলার হরিনমারা, তেলুমিয়া পাড়া, ইসলামপুর, গজালিয়া, মুসলিম পাড়া, চেয়ারম্যানপাড়া, হরিণঝিড়ি, টিঅ্যান্ডটি এলাকা, সরই, রূপসীপাড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উত্তরপাড়া, বাইশফাঁড়ি, আমতলী, রেজু, তুমব্রু, হেডম্যানপাড়া, মনজয় পাড়া, দৌছড়ি, বাইশারী, রুমা উপজেলার হোস্টেলপাড়া, রনিনপাড়াসহ সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের ঢালে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে তুলেছে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি পরিবার। এবছর পাহাড়ের ঢালে নতুন নতুন বসতি গড়ে ওঠায়, গত বছরের তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে গেছে। পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারীদের বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ।
স্থানীয়দের মতে, অনেকটা বাধ্য হয়েই এই মানুষেরা পাহাড়ের ঢালে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। তাদের মতে, পাহাড়ের ভূমি অন্যান্য সমতল ভূমির চেয়ে অনেকটা সস্তা। তাছাড়া, এর চেয়ে ভালো জমি কেনার সামর্থ্যও নেই অনেকের। এ কারণেই অতিদরিদ্ররা কম দামে পাহাড় কিনে মাটি কেটে এর পাদদেশে বসতবাড়ি নির্মাণ করছেন। বিকল্প কোনও জায়গা না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই তারা এখানে বসবাস করছে। ফলে প্রতি বছরই প্রবল বর্ষণের সময় পাহাড় ধসে মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বান্দরবানের ইসলামপুর, লাঙ্গিপাড়া, কালাঘাটা, বনরূপা পাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে গতবারের চেয়ে আরও বেশি ঝুঁকিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বসতবাড়ি। বড় বড় পাহাড় কেটে একটির ওপরে আরেকটি এভাবে ধাপে ধাপে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়িগুলো। ফলে দু-চার দিন প্রবল বর্ষণ হলেই পাহাড় ধসে এসব ঘরবাড়ির মানুষগুলোর প্রাণহানি ঘটতে পারে। এ বিষয়ে ইসলামপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘এখানে যারা বসবাস করছেন, তারা অত্যন্ত গরিব এবং খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের প্রতি আমাদের আবেদন—তাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে বর্ষার সময় প্রবল বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে প্রায় সময়ই মানুষ মারা যায়। তাদের সরিয়ে না নিলে সামনের বর্ষাতে ফের পাহাড় ধসে মানুষ মারা যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।’
পাহাড়ের পাদদেশে থাকা আমেনা বেগম বলেন, ‘আমরা এখানেই থাকি। বর্ষাতেও এখানে থাকি। তবে বেশি বৃষ্টি হলে এখানে পাহাড় ধসে পড়ে। তখন থাকার মতো কোনও পরিবেশ থাকে না। তাই আমরা চাই, সরকারিভাবে আমাদের জন্য যেন একটি ভালো থাকার ব্যবস্থা করা হয়।’ পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারী আরেক নারী মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘এটি ছাড়া আমাদের আর কোনও থাকার জায়গা নেই। তাই আমাদের মরলেও এখানে থাকতে হবে, বাঁচলেও থাকতে হবে।’
এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দা নূর হোসেন বলেন, ‘পাহাড় কেটে জমি নিচু করে এর পাদদেশে ঘর বাঁধার কারণেই বর্ষার সময় বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে ঘরের ওপরে ধসে পড়ে। আর এসময় ঝুঁকি নিয়ে থাকা মানুষগুলোই মাটিচাপা পড়ে মারা যায়। ’ সরকারিভাবে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পাহাড় ধসে গত ১২ বছরে বান্দরবান জেলায় ৭৭ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে ২০০৬ সালে জেলা সদরে তিন জন, ২০০৯ সালে লামা উপজেলায় শিশুসহ ১০ জন, ২০১০ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় পাঁচজন, ২০১১ সালে রোয়াংছড়ি উপজেলায় দুজন, ২০১২ সালে লামা উপজেলায় ২৮ জন ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১০ জন, ২০১৫ সালের লামায় চারজন, সিদ্দিকনগরে একজন ও সদরের বনরূপায় দুজন, ২০১৭ সালে কালাঘাটায় সাত জন ও রুমা সড়কের দনিয়াল পাড়ার কাছে পাঁচজন পাহাড় ধসে মারা গেছেন।
এদের মধ্যে দুই-চার জন পাহাড় কাটতে গিয়ে মারা গেলেও বেশির ভাগই মারা গেছেন বর্ষাকালে পাহাড় ধসে। এ ব্যাপারে বান্দরবান মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘অপরিকল্পিত উপায়ে পাহাড় কেটে ভৌত অবকাঠামো, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট তৈরি করার কারণে পাহাড় ধস বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া, গাছ কাটার কারণে পাহাড়ের ওপরের অংশের মাটি খুব সহজেই পানিতে ধুয়ে গিয়ে পাহাড়কে দুর্বল করে ফেলে। ফলে অতিবৃষ্টির সময় এসব পাহাড় সহজেই ভেঙে পড়ে। পরিণামে মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে পাহাড় ধসের ফলে অনেক মানুষ মাটিচাপা পড়ে মারা গেছেন। বাড়িঘর ভেঙে গেছে। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আমাদের এখনই সর্তক হতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হবে।’ মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও যারা পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন, তাদেরকে খুব তাড়াতাড়ি নিরাপদে সরিয়ে নিতে হবে। তা না-হলে ভবিষ্যতে আরও বেশি জীবনহানি ঘটতে পারে।’
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেন বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসন থেকে এবিষয়ে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি বান্দরবানের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে এবিষয়ে একটি বৈঠক করেছি। ওই বৈঠকে কোন কোন পাহাড়ে কী পরিমাণ মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছে, জরুরি মুহূর্তে তাদের যেন অন্য স্থানে সরিয়ে আনা যায়, এসব বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছি।’
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এছাড়া, জরুরি মুহূর্তে তাদেরকে আমরা কোন জায়গায় সরিয়ে নিতে পারি, তাও ঠিক করে রেখেছি। এখানকার পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ আবাস ভূমি, যেসব স্থানে মানুষের সংখ্যা বেশি, সে বিষয়েও আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।’ তিনি বলেন, ‘অতিবর্ষণের কারণে যাতে পাহাড় ধসে না যায়, সেজন্য পাহাড় না কাটার ক্ষেত্রে প্রশাসনিকভাবে এ জেলার সব নির্বাহী ম্যাজিস্টেট এবং পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বান্দরবান জেলায় কোনোভাবেই কেউ যাতে পাহাড় কাটতে না পারে, পাথর উত্তোলন করতে না পারে এবং পাহাড়ের কোনও রকম ক্ষতি করতে না পারে, তাও বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানান, সামনের দিনগুলোতে পাহাড় ধসের কারণে যাতে কোনও ধরনের প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে, সেজন্য প্রশাসন থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারিভাবে পাহাড়ের পাদদেশে এবছর কতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ নতুন বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে, তার কোনও তালিকা এখনও পাওয়া যায়নি।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি