২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ৯:০২

বৃহৎ ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে ব্যাংকিং খাত

অর্থনীতি ডেস্ক :

বড় বড় উদ্যোক্তাদেরকে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ দিয়ে ঝুঁকিতে দেশের ব্যাংকিং খাত। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ছোট উদ্যোক্তাদের ঠকিয়ে প্রভাবশালীদের অব্যাহতভাবে দেওয়া হয়েছে বড় অঙ্কের ঋণ। আর তারা যথাসময়ে টাকা ফেরত না দেওয়ায় সংকটে পড়েছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতের মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশই দেওয়া হয়েছে বৃহৎ অঙ্কের ঋণ।

এতে বলা হয়েছে, গত বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের মূলধন ছিল ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ১৩ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ৩৬৫ শতাংশ। একই সময়ে সোনালী ব্যাংক ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ৫৪৬ শতাংশ।

আর রূপালী ব্যাংক দিয়েছে মোট মূলধনের ৫৫৫ শতাংশ।

অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ছিল ৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে ৭ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। এই হিসাবে ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছে মোট মূলধনের ১৯৯ শতাংশ।

এভাবে ৫৫টি ব্যাংক তাদের ৯০ হাজার ১৩১ কোটি টাকা মূলধনের বিপরীতে ঋণ দিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা। যা মোট মূলধনের ২৩৩ শতাংশ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য উদগ্রীব থাকেন। অথচ তারাই ঋণ পাচ্ছেন না। কিন্তু প্রভাবশালীরা ঠিকই পেয়ে যাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যাংকও টাকা আদায় করে স্বস্তি পায়। কিন্তু প্রভাবশালীরা টালবাহানা করে। এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ে। ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যেই বেশি।  যদিও তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।’

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা বলছেন, কৃষক ও ছোট উদ্যোক্তারা যথাসময়ে ঋণের টাকা ফেরত দিলেও প্রভাবশালীরা দিচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে ঝুঁকিও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৫টি ব্যাংক বড় ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিয়েছে সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। যা মোট দেওয়া ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, কোনও ব্যাংকের মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ নিলেই তা বড় অঙ্কের ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণ ব্যাংক কোনও একক গ্রাহককে ১৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। এর বেশি ঋণ দিতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগে।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক কোনও গ্রাহককে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৌশলে এই আইন অমান্য করে অনেক প্রভাবশালী গ্রুপকে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিয়েছে। এক্ষেত্রে একই গ্রাহকের একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে মূলধনের চেয়ে বেশি ঋণ নিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণার তথ্য বলছে, যথাসময়ে ফেরত না দেওয়ায় অধিকাংশ বড় অঙ্কের ঋণই খেলাপি হয়ে পড়ছে। এই খেলাপির ঋণের একটি বড় অংশ অবলোপনও করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যার প্রভাবে ভালো গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিআইবিএমের তথ্য অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছর ধরে ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলসহ নানামুখী সুবিধা পেয়েছে বড় ব্যবসায়ীরা। অথচ যেসব ছোট ব্যবসায়ী পুনর্গঠন ও ঋণ পুনঃতফসিল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তারাই ঋণের টাকা পরিশোধে এগিয়ে রয়েছেন। পুনঃতফসিল করা বড় অঙ্কের ঋণের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকা আদায় করতে পারেনি ব্যাংক। কিন্তু ছোট অংকের ঋণের আদায় সন্তোষজনক। তবুও ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও ছোট গ্রাহকের চেয়ে বড় গ্রাহকের দিকে ঝুঁকছে।

বিআইবিএম’র প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বড় ঋণের পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। ২০১০ সালে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা (৫০ কোটি টাকার বেশি) ঋণের মধ্যে বৃহৎ বা বড় ঋণ ছিল ১৮. ৮০ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে হয় ২১.৪৩ শতাংশ, ২০১২ সালে হয় ২২.৩৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে ২৩.৭৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে বড় ঋণের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩১. ৫৯ শতাংশ।

বৃহৎ অঙ্কের ঋণের মধ্যে ২০১০ সালে খেলাপি ঋণ ছিল সাড়ে ৪ শতাংশ, ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৫.৪০ শতাংশ।  মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে ২০১০ সালে বড় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭.৯৬ শতাংশ। ২০১১ সালে হয় ৩৮.১১ শতাংশ ও ২০১২ সালে ৪০.৪১ শতাংশ। ২০১৩ সালে বড় খেলাপি আরও বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৪২.০৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪৩.৮২ শতাংশ। অবলোপন করা ঋণের মধ্যে বৃহৎ ঋণই বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ ভিত্তিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীর্ষ তিনজন করে ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলেই ঝুঁকিতে পড়বে দেশের ২৫টি ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সংকটকালীন সহন ক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং পরীক্ষায় দেখা গেছে, র্শীষ তিনজন ঋণগ্রহীতার খেলাপির বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করার সক্ষমতা নেই ব্যাংকগুলোর। একইভাবে শীর্ষ ৭ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ঝুঁকিতে পড়বে ২৯টি ব্যাংক এবং শীর্ষ ১০ ঋণগ্রহীতা খেলাপি হলে ৩৫টি ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করতে পারবে না।

এদিকে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংকই এখন বেকায়দায় আছে। বেশির ভাগ বড় ঋণগ্রহীতা টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকিং খাতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে ২২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতকে প্রভাবশালী মুক্ত করতে না পারলে কোনোভাবেই এই খাতে সুশাসন আসবে না। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি।’

তিনি মনে করেন, ১০০ জন ছোট উদ্যোক্তা ঋণের টাকা নিয়ে ৯৫ জনই সময়মতো ফেরত দেওয়ার জন্য পেরেশান থাকে। কিন্তু বড় উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই পুনঃতফসিল করার চেষ্টায় থাকে।

দৈনিক দেশজনতা/ টি এইচ

প্রকাশ :এপ্রিল ২২, ২০১৮ ১:৩৫ অপরাহ্ণ