২২শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সকাল ১০:০০

কোচিংবাণিজ্য বন্ধ: সাপ-লুডু খেলছে সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের আখড়া বাংলাদেশের কোচিং সেন্টারগুলো নিয়ে সরকারের সাপ-লুডু খেলা থামছেই না। দেশের প্রশ্নফাঁসসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে কোচিং সেন্টারগুলোর জড়িত থাকার নানা তথ্যপ্রমাণ মেলার পরও সরকারের তরফ থেকে কোচিংবাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অথচ বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতায় কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তাদের নানা বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে প্রায় সময়।

অনেকে বলছেন, যারা কোচিংবাণিজ্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিজেদের অবস্থানের কথা বলছেন, গোপনে গোপনে এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া খুবই ভালো। না হলে, যেসব ব্যক্তি বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এক কলমের খোঁচায় কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করতে পারেন তাদের এত বড় বড় কথা বলা কী দরকার? কোচিং বন্ধ করলেই তো ল্যাঠা শেষ হয়ে যায়। গতকাল শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দুদকের সততা সংঘের এক সমাবেশে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের জের টেনে বলেছেন, কোচিং সেন্টারগুলো শুধু অবৈধ নয় দুর্নীতির আখড়াও। যে কোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং কোচিংবাণিজ্য চিরতরে বন্ধ করতে হবে। আমাদের সন্তানরা সারা দিন কোচিং সেন্টারে ঘুরে বেড়াবে তা হতে পারে না। তিনি সরকার, ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, আসুন, এই অবৈধ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করি।

গত বুধবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এইসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেশের সব কোচিং সেন্টার অবৈধ। এসব কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, কোচিং সেন্টার অবৈধ হলেও এগুলো বন্ধের ক্ষমতা আমাদের নেই। তাই এ জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেওয়া হবে। সব কোচিং সেন্টার বন্ধ করা হবে। তিনি জানান, আমরা শিক্ষা আইন তৈরি করছি। সে আইনে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়েছে। শিক্ষা আইন পাস হলেও সব কোচিং সেন্টার বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে। হাইকোর্টের রায়ের কথা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কোচিং সেন্টার, গাইড বই, নোট বই সব বেআইনি। তারপরও দেশে অনেক অপরাধ ও বেআইনি কাজ হয়। ইচ্ছা করলেই সব বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষার আগ থেকে দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। পরীক্ষা শুরুর চার দিন আগে অর্থাৎ গত ২৯ মার্চ থেকে সব কোচিং বন্ধ থাকার কথা রয়েছে। আগামীকাল থেকে শুরু হচ্ছে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা। শিক্ষামন্ত্রীসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল থেকে দীর্ঘদিন ধরে কোচিংবাণিজ্য ও গাইড বই ব্যবসা বন্ধের দাবি উঠলেও সরকারের তরফ থেকে বারবার কোচিং সেন্টারগুলোকে নিয়ে সাপ-লুডু খেলা চলে এসেছে। এসব কারণে সাধারণ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। আহমেদ শফিক নামের উত্তরার এক স্কুলশিক্ষক বলছিলেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে কোচিংবাণিজ্য। মূলত, শিক্ষাকে যেদিন থেকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে সেদিন থেকেই কোচিং সেন্টারের উৎপাত শুরু হয়েছে। গাইড ও কোচিং ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্কুলগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের সময় স্কুলে যা পড়েছি, শিক্ষকরা যা শিখিয়েছে তা দিয়েই পরীক্ষা দিতাম। পাস করলে পাস ফেল করলে ফেল। এ নিয়ে আমাদের বাবা-মায়েদের কোনো চিন্তা ছিল না। কিন্তু শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করার পর থেকে আমাদের মূল্যবোধের অবনমন শুরু হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক সব পর্যায়েই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। শিক্ষকরা ক্লাসে ভালো মতো পড়ান না। অভিভাবকরা সন্তানদের ভালো শিক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি করান। সন্তানদের টাকা উৎপাদনের যন্ত্র বানান এবং করপোরেট ব্যবস্থার দাস বানানোর জন্য সঁপে দেন। আর এ সুযোগ পুরোমাত্রায় লুফে নেয় কোচিং সেন্টারগুলো। ফলে যেখানে বাণিজ্য, লাভ-লোকসানের হিসাব আছে, সেখানে তো ঘুষ, দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ভর্তিবাণিজ্য থাকবেই। এগুলো শিক্ষার বাণিজ্যকীকরণেরই বাই প্রোডাক্ট। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাবার্তা সম্পাদক এএন রাশেদা বলেন, দেশে শিক্ষা বলতে জিনিসটাই নেই। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধংস করে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষাকে বাণিজ্যিক খাতে পরিণত করে পুরো ব্যবস্থার বারোটা বাজানো হয়েছে। প্রশ্নফাঁস, ভর্তিবাণিজ্যসহ নানা বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের দুষেছেন বিভিন্ন সময়। অথচ তাদের নিজেদের অপকর্মের কথা দিব্যি এড়িয়ে যান। তারা চাইলেই পারেন প্রশ্নফাঁস, ভর্তিবাণিজ্য, কোচিংবাণিজ্য রোধ করতে। এক কলমের খোঁচার ব্যাপার। কিন্তু তারা সেটা করবেন না। কারণ, এটার সঙ্গে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য সম্পৃক্ত। জড়িত একটা বিশাল সিন্ডিকেট। মুখে বড় বড় কথা বলে তারা একটা আইওয়াশ করেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। এত বড় বাণিজ্য হাতছাড়া করবে কে? অথচ বলা হচ্ছে, শিক্ষকরা ঠিকমতো ক্লাস করান না, স্কুলগুলো মান ঠিক রাখতে পারছে না। অনেক শিক্ষক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, আপনি শিক্ষকের বেতন দেবেন না, তাকে বেঁচে থাকার রসদ দেবেন না আবার তার সামনে দুর্নীতির সব দরজা খোলা রাখবেন তখন তো যে কেউই সে ফাঁদে পা দেবে। আগে তো ব্যবস্থাটা ঠিক করতে হবে।

দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকর্মে জড়িয়ে কোচিং সেন্টারগুলো অনেকটা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। নানা সমালোচনার মুখে এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হম্বিতম্বিতে চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে নিজেদের খোলস পাল্টাতে শুরু করেছে তারা। রাজধানীর ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকার প্রসিদ্ধ কোচিং সেন্টারগুলোর কিছু কিছু নাম বদলে ফেলছে। আবার কিছু কিছু কোচিং সেন্টার নিজেদের আর কোচিং সেন্টার বলে পরিচয় দিচ্ছে না। সাইনবোর্ডে লিখছে, ‘স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি সেন্টার’ বা শিক্ষার্থী পরামর্শ কেন্দ্র। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থী পরামর্শ কেন্দ্রের নামে রাজধানীর দুই অংশেই অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চাতুরীর আশ্রয়ে এবং বিধিমালার নানা ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে এরা ট্রেড লাইসেন্সও জোগাড় করছে অবাধে। ফলে সরকার ‘কোচিং’ শব্দটি বন্ধ করলেও নতুন করে হাজির হতে পারে ‘কনসালটেন্সি’ নামের খোলস পাল্টানো অপকর্মের পুরনো আখাড়া।

দৈনিকদেশজনতা/ আই সি

প্রকাশ :এপ্রিল ১, ২০১৮ ১১:২৭ পূর্বাহ্ণ