বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক :
দেশের অনেক জায়গায় এখনো তৃতীয় প্রজন্মের (থ্রিজি) ইন্টারনেট পরিসেবা চালু হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফোরজি ইন্টারনেট পরিসেবা চালুর পর তার কার্যক্রম নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন গ্রাহকসহ অনেকেই। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশের তিন মুঠোফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক ফোরজির লাইসেন্স পায়। পরের দিন একযোগে ৬৪ জেলায় ফোরজি সেবা চালুর ঘোষণা দেয় রবি। তাদের দাবি সেটি চার দশমিক পাঁচজি। একই দিন গ্রামীণফোনও ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় ফোরজি সেবা চালু করেছে। এদিকে বাংলালিংক ঢাকার কিছু এলাকাসহ খুলনায় চালু করেছে ফোরজি। কিন্তু তারপরও সেই সেবা এখনো গ্রাহকদের কাছে সোনার হরিণ।
তবে ফোরজি চালুর সময় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘ফোরজি সেবা চালু দেশের টেলিযোগাযোগ খাত এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য একটি বড় মাইলফলক। বিটিআরসি এখন সেবার গুণগতমান নিশ্চিত করতে অনেক বেশি তৎপর। সেবা মানসম্পন্ন না হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্রিজি সেবা চালু হওয়ার পর সেবার মান নিশ্চিত করা দূরে থাক, কলড্রপ বেড়ে যাওয়াসহ সার্বিকভাবে টেলিযোগাযোগের মান নিম্নগামী হয়েছিল। ফোরজির ক্ষেত্রেও একইভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এখন ফোরজির জন্য উপযোগী স্মার্টফোনের সহজলভ্যতাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা বর্তমান বাজারে ফোরজির ব্যবহার উপযোগী স্মার্ট হ্যান্ডসেট রয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ।
অনেকেই বলছেন, দুরন্ত গতির নিশ্চয়তা নিয়ে চালু হয়েছিল থ্রিজি। আর সেটি চলছে শামুকের গতিতে। এমন পরিস্থিতি ফোরজি চালু করে যে বিপ্লব করার চেষ্টা চলছে সেটির বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বর্তমানে দেশের প্রতি একহাজার মুঠোফোনের মধ্যে দুটিরও নেই এ প্রযুক্তি ব্যবহার করার সক্ষমতা। আছে ফোনের উচ্চমূল্য আর ফোরজি উপযোগী পরিবেশের অভাবও। তাহলে কেমন করে সবার কাছে পৌঁছবে এই সেবা? কেমন করেই বা টেলিযোগাযোগের নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ?
একাধিক মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কাছে ফোরজি সমর্থিত স্মার্টফোন থাকলেও নেটওয়ার্ক কাভারেজ নেই। আবার নেটওয়ার্ক আছে তো মুঠোফোন সেট ফোরজি সাপোর্ট করছে না। আইফোন থাকলেও তাতে মিলছে না ফোরজি, সিম ফোরজি হলেও সেট নয় বা সেট ফোরজি হলে সিম থ্রিজি বা আরও আগের। ফলে সবার ভাগ্যে জুটছে না ফোরজি। টেলিটকের গ্রাহকদের অপেক্ষা ফুরায়নি। আর কতদিন তাদের অপেক্ষা করতে হবে, তাও অনিশ্চিত। ফলে বেশিরভাগ গ্রাহকই এই সেবার বাইরে রয়ে গেছে। তবে মুঠোফোন অপারেটররা বলছেন, পর্যায়ক্রমে সারা দেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ফোরজির আওতায় আনা হবে।
জানা যায়, ফোরজি সেবা নিতে হবে যে ডিভাইসটি দিয়ে সেটির সংখ্যাও বাজারে কম। দেশে ব্যবহার হওয়া তিন কোটির বেশি স্মার্টফোনের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ সেটে ফোরজি ব্যবহার করা যাবে। আবার ফোরজি সমর্থিত স্মার্টফোনের দামও বেশি। এসব সমস্যা দ্রুত কেটে যাবে জানিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘দেশে স্মার্টফোন উৎপাদন শুরু হয়েছে। দুটি কোম্পানি কাজ শুরু করেছে। আরও একটি কোম্পানি অনুমোদন নিয়েছে। দুয়েকটি কোম্পানির প্রস্তাব পাইপ লাইনে রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে অন্তত পাঁচটি কোম্পানি দেশে মোবাইল ফোন তৈরি করছে।’ দেশে তৈরি ফোরজি মোবাইলের দাম কম হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দেশে ফোরজি ডিভাইসের কোনো সংকট থাকবে না।’
দেশের ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অনেকেই বলছেন, থ্রিজির থেকে ফোরজি ব্যবহারে খুব একটা পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে না। ফোরজি চালুর পর মুঠোফোনে আগের থেকে অনেক বেশি কলড্রপ হচ্ছে। কাওসার আহমেদ বলেন, ‘অপারেটরগুলো নেটওয়ার্ক দেবে টুজি স্পিডে, কিন্তু এখন থেকে টাকা কাটবে ফোরজি স্পিডে। গ্রাহক থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নেবে কোটি কোটি টাকা।’ সানজিদা খাতুন নামের একজন গ্রাহক বলেন, ‘এখনো থ্রিজির নেটওয়ার্কই নেই দেশের কিছু কিছু এলাকায়। আর যেখানে থ্রিজি আছে তাও আবার কোনোরকম। আর গ্রামের থ্রিজি যেন পান্তা ভাত মনে হয়। আমরা যারা ফোরজি ব্যবহার করছি, কোথাও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই।’
হাফিজ বলেন, ‘ফোরজি চালু হওয়ার পর আমি নিজেই টেনশনে পড়ে গেছি, কারণ আমার এত দামের ফোনটি নাকি ফোরজি সাপোর্ট করবে না, আমার জানা মতে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের কাছে থ্রিজি মোবাইল ফোন আছে।’ মাসুম খান বলেন, ‘হাসব না কী করব বুঝতাছি না। কারণ খোদ ঢাকার একটি ব্যস্ত এলাকাতে গ্রামীণফোনের নেট থাকে না বাসাবাড়িতে। সেখানে ফোরজি। এটা হাস্যকর।’ আশফাক-উজ-জামান নূর বলেন, ‘ফোরজি সেবা দেওয়ার আগে আমাদের চিন্তা করতে হবে আমরা কি এখন পর্যন্ত থ্রিজি সারা দেশে নিশ্চিত করতে পেরেছি?’
প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘থ্রিজি সেবার মান নিশ্চিত করার সমস্যাগুলো যাতে ফোরজিতেও না থাকে, সে জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দ্রুত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ। যা মোবাইল ফোন অপারেটরদের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন (বিটিএস) বসানো না হলে ফোরজিতেও নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত করা যাবে না।’
মুঠোফোন গ্রাহকদের ঘাড়ে করের বোঝা : সিম প্রতিস্থাপনে ১১০ থেকে ১২৫ টাকার কারণে শুরুতেই ধাক্কা খাচ্ছে ফোরজির আগ্রহ। অনেকেই দামের কথা শুনে ফিরে যাচ্ছেন। সরেজমিন রাজধানীতে বিভিন্ন অপারেটরের নিজস্ব গ্রাহক সেবাকেন্দ্র ও খুচরা বিক্রেতা পর্যায়ের সেবাকেন্দ্রে গিয়ে সিম প্রতিস্থাপনের ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে সাধারণের মধ্যে। মুঠোফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবীর বলেন, ফোরজি সেবার সুবিধা সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সিম প্রতিস্থাপন করা, ইন্টারনেট ব্যবহার এবং হ্যান্ডসেট আমদানিতে ভ্যাট প্রত্যাহার করা জরুরি।
দেশে চালু হওয়া ফোরজির ন্যূনতম গতি ২০ এমবিপিএস নির্ধারণ করেছে সরকার। ফোরজি সেবার মান নির্ধারণে বিটিআরসি এর আগে যে নীতিমালা তৈরি করেছিল সেখানে ফোরজির ন্যূনতম গতি ধরা হয়েছিল ১০০ এমবিপিএস। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে তা কমিয়ে পরে ২০ এমবিপিএস নির্ধারণ করেছে বিটিআরসি। তবে এই গতিকে অবাস্তব অভিহিত করে মোবাইল ফোন অপারেটররা বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ২০ এমবিপিএস (মেগা বিট প্রতি সেকেন্ড) গতির ফোরজি সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরদের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি তরঙ্গ আছে রবি আজিয়াটার। বিভিন্ন ব্যান্ডে রবির মোট তরঙ্গের পরিমাণ এখন ৩৬ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ। গ্রামীণফোনের ৩২ মেগাহার্টজ, টেলিটকের ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্টজ ও বাংলালিংকের কাছে ২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ আছে। তাদের মতে, ২০ এমবিপিএস ন্যূনতম গতির ফোর-জি সেবা দিতে হলে তাদের তরঙ্গ দরকার কমপক্ষে ৬০ মেগাহার্টজ। কিন্তু এত তরঙ্গ ব্যবহারের সুযোগ বর্তমানে নেই।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওপেন সিগন্যালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ফোর-জি প্রযুক্তির গড় গতি ১৬ দশমিক ৬ এমবিপিএস। ফোরজি গতিতে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দুটি দেশ হলো সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। সিঙ্গাপুরে এখন ফোরজির গড় গতি ৪৬ দশমিক ৬৪ এমবিপিএস, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪৫ দশমিক ৮৫ এমবিপিএস। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, এই দুটি দেশ ছাড়া ৪০ এমবিপিএসের বেশি গতি পাওয়া যায় নরওয়ে ও হাঙ্গেরিতে। এ দুটি দেশে ফোর-জির গড় গতি ৪২ এমবিপিএস। অপরদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ফোরজির গড় গতি বর্তমানে ৬ দশমিক ১৩ এমবিপিএস। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশে ফোরজির গতি ৯ থেকে ১৪ এমবিপিএসের মধ্যে।
প্রতি গিগাবাইট ইন্টারনেট ডাটা কিনতে সেলফোন অপারেটরদের ব্যয় হয় গড়ে ২৬ পয়সা। অথচ গ্রাহকের কাছে একই পরিমাণ ডাটা ২০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করছে অধিকাংশ অপারেটর। এতে ব্যান্ডউইডথের দাম দফায় দফায় কমানো হলেও তার সুফল পাচ্ছে না গ্রাহক। ডাটার এই আকাশছোঁয়া দামের কারণেও ফোরজি কার্যক্রম নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি