২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | সন্ধ্যা ৭:৪২

শহীদ দিবস অমর হোক

আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও দিনটি পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ এডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃৃথক বাণী দিয়েছেন। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক- সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মধ্যরাতের পর থেকে কেšদ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পন, আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারত, আলোচনা সভা। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি ও বাংলা একাডেমীর যৌথ উদ্যোগে একাডেমী চত্বর ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা-১০১৮।
১৯৫৩ সাল থেকে এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবেই পালন করে আসছে এদেশের মানুষ। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের এদিনে পূর্ব বাংলার ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে এসেছিল প্রত্যয় দৃপ্ত শপথ নিয়ে। সেদিন ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পাকিস্তানি শাসক-গোষ্ঠী নির্বিচার গুলী চালিয়েছিল প্রতিবাদী ছাত্র জনতার মিছিলে। স্বৈরশাসকের ঘাতক বুলেট সেদিন কেড়ে নিয়েছিল বরকত, রফিক, শফিউর, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকের।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের আহ্বান বিফলে যায়নি। বাংলাভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাবোধের যে চেতনা জাগ্রত হয়, তা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়েই এগিয়ে যায় আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। নানা চড়াই-উৎরাই, ঘাত-সংঘাত ও আত্মদানের পর ১৯৭১ সালে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অবসান ঘটে স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে।
ভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পার করার পর আজ যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে তাহলো-সেদিনের আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য কতোটা সফল হয়েছে। এটা ঠিক পরবর্তীতে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতোটা এগিয়েছি আমরা? ভাষা আন্দোলনের যে উদ্দেশ্য ছিল তার কতোটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি? স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে আর ভাষা শহীদ দিবসের ছেষট্টি বছর পেরিয়ে যদি প্রকাশ করতে যাই, তাহলে অর্জনটা খুব বড়ো হয়ে যে দেখা দেবে না, সে বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। বরং আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে হতাশা ঘিরে ধরে। সর্বত্র নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এমনভাবে শুরু হয়েছে যে, এ জাতির ভবিষ্যত নিয়ে যারা ভাবেন, তারা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না। জাতির ভবিষ্যত যারা, তারা বিদেশী অপসাংস্কৃতিক অনুসঙ্গগুলোকে আঁকড়ে ধরছে ভীষণভাবে। নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে অবজ্ঞা করে বিদেশী সংস্কৃতির প্রতি তারা ভয়ঙ্কর রকম অনুরক্ত। উঠতি তরুণরা এখন বই পড়ে না। তারা কম্পিউটার নির্ভর হয়ে পড়ছে। বইয়ের পরিবর্তে তাদের হাতে এখন স্মার্ট ফোন। বই পড়ার পরিবর্তে তারা ফেসবুকে ব্রস্ত থাকতেই পছন্দ করে। তারা বর্তমান নিয়েই ব্যস্ত। জানারও চেষ্টা করে না আমাদের অতীত ঐতিহ্যের কথা। এরা ফেসবুক আর ব্লগের মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলছে। এরা জানতে পারবেনা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা। এরা বুঝছে না যে, অতীতকে ভালোভাবে না জানলে ভবিষ্যত বিনির্মানে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া যায় না।
অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। ’৫২ তে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের স্বপ্ন ছিল বাংলা হবে একটি সমৃদ্ধভাষা, এদেশ হবে সমৃদ্ধশালী দেশ, আমাদের সাংস্কৃতিক ভান্ডার হবে ঐশ্বর্যশালী। ছয় দশক পরেও আমরা সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। এ ব্যর্থতা কারো একার নয়, গোটা জাতির।
প্রতি বছর শহীদ দিবস আসে, যায়। এ দিনটিকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় নানা অনুষ্ঠানের। সেসব অনুষ্ঠানে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন বড় বড় মানুষেরা। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে খুব কম। এভাবে চলতে থাকলে ভাষা শহীদদের স্বপ্ন কখনোই পূরণ হবে না। আজকের এ দিনে তাই আমাদের শপথ হওয়া উচিত অপসংস্কৃতিকে বর্জন করে বাংলাভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখার। শহীদ দিবস অমর হোক।

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৮ ৮:১৫ অপরাহ্ণ