নিজস্ব প্রতিবেদক:
যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে যেতে চায় বলে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলে আসছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। আর নির্বাচনের ‘একতরফা’ তকমা এড়াতে আওয়ামী লীগও চায় বিএনপি নির্বাচনে আসুক। তবে সেক্ষেত্রে পূর্ণশক্তির বিএনপিকে ক্ষমতসীনরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চায় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সম্ভাব্য একাধিক বিকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বলেই দলটির নেতাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত মিলছে। প্রথমত: খালেদা জিয়া বিহীন অথবা বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে আনা। আর খালেদা ইস্যুতে বিএনপি নির্বাচনে না আসলে ‘নামসর্বস্ব’ হলেও যতবেশি সংখ্যক দলকে নিয়ে নির্বাচন করে তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করা।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বিএনপি অবশ্যই আগামী নির্বাচনে আসতে হবে। আওয়ামী লীগও চায় সব দল নির্বাচনে আসুক। তবে এক্ষেত্রে কারাভোগরত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারলেন নাকি পারলেন না সেটি মুখ্য নয়। দেশে-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে যতটুকু প্রয়োজন এর বাইরে ছাড় দেয়া যাবে না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের বিচার হওয়া উচিত। দুর্নীতি আর রাজনীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। দুর্নীতিবাজদের নির্বাচন করার অধিকারও থাকে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ চায় বিএনপিসহ সব দলই নির্বাচনে আসুক। তবে কেউ নির্বাচনে আসুক বা না আসুক সংবিধানসম্মতভাবে যথাসময়ে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ চায় সব দলই নির্বাচনে আসুক। তাই বিএনপির নেতাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়া উচিত। তবে তিনি বলেন, বিএনপি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসবে, নাকি ছাড়া আসবে এটা তাদের ব্যপার। এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না।
খ্যাদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, বিএনপি যদি নিজেদের অন্তিম ঘণ্টা না বাজাতে চায়, তাহলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে তারা খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনে আসবে নাকি ছাড়া আসবে সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া একজন চিহ্নিত, অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজ। তাই বিএনপির এক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে এগোনো উচিত। তাছাড়া খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি পারবেন না এটা আদালত জানেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, খালেদা জিয়া একটি বড় রাজনৈতিক দলের সভানেত্রী। দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে তার দল বিএনপি তাকে নিয়ে নির্বাচনে আসবে নাকি আসবে না এটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। খালেদা জিয়ার রায়ে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে আমি বিশ্বাস করি।
সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, খালেদা জিয়ার রায়ের কারণে তার প্রতি বিএনপির কী মনোভাব এটা দলটিই ভালো জানে। তবে দুর্নীতি মামলায় তার সাজা হওয়ায় দলের নেতাকর্মীরা সাহস ও আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, বিএনপি কী বলে না বলে এনিয়ে ভাববার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের অবস্থান খুবই পরিষ্কার। খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড তার দুর্নীতির কারণে দেয়া হয়েছে, রাজনৈতিক কোনো কারণে নয়। তিনি বলেন, আমরা চাই সকল দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসতে পারবেন কিনা তা আদালত জানেন। এটা নির্বাচন কমিশন এবং আওয়ামী লীগের বিষয় নয়।
ক্ষমতাসীন দলের এমন মনোভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আওয়ামী লীগ যে কোনো মূল্যেই যে ক্ষমতায় থাকতে চায় এবং নির্বাচনে জিততে চায়, এটা তাদের কার্যকলাপ থেকেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, আজ খালেদা জিয়াকে জেলের ভেতর রেখে তারা (সরকার) বলছে বিএনপি যাতে নির্বাচনে আসে এবং প্রস্তুতি নেয়। এ কথা থেকেই তো বোঝা যায় তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে বিএনপির যে অংশ নির্বাচনে যেতে চাইবে, তাদের নিয়ে নির্বাচন হবে।
সুজন সম্পাদক বলেন, এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ শুধু বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি নয়, বেশি বেশি দলকে নিয়ে নির্বাচনের কথা ভাবছে। তবে অনৈতিক কোনো কিছুর পরিণামই শুভ হয় না। আওয়ামী লীগ যদি ভাবে তারা অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় থাকবে, নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদল হতে দিবে না, তাহলে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে, অশান্ত এবং সহিংসতার মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হবে। খালেদা জিয়া ছাড়া তো আর বিএনপি না। এখানে তাকে বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, আওয়ামী লীগের উচিত হবে সব দল নিয়েই নির্বাচন করা। তাহলে তারা তাদের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে পারবে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দলটির নেতাদের বক্তব্য থেকে যা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল চায় না খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসুক। তবে তারা একই সঙ্গে চাচ্ছে বিএনপি যাতে আসে। তাহলে এর মানে কী দাঁড়ায়? বলাই যায় বিএনপির একটি অংশ। নিশ্চই এক্ষেত্রে কোনো না কোনো কথা হয়েছে।
অজয় রায় বলেন, আওয়ামী লীগও চাচ্ছে বিএনপি, জেপি, বামপন্থি দলগুলোসহ মোটামুটি সকল দল যেন এই নির্বাচনে আসে। তবে তাদের করণীয় হবে এজন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। অবশ্যই খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে নয়, যা তারা চাচ্ছে। কারণ খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে আওয়ামী লীগ কিন্তু আশঙ্কায় ছিল এবং আছে। তারা নিজেদের ফাঁদেই ফেঁসে গেছে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনে খালেদা জিয়াও আসবেন, বিএনপিও আসবে। আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ পাবে না। তিনি বলেন, ‘ইন্ডিয়ান (গোয়েন্দা সংস্থা) ‘র’ এর এজেন্টদের মাধ্যমে বিএনপিতে ফাটল ধরিয়ে বিএনপির একটা অংশ নিয়ে নির্বাচন করার যে পাঁয়তারা, তা কখনোই বাস্তবায়ন হবে না।’ ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে বলছে। কিন্তু তাদের খালেদা জিয়ায় এতো ভয় কেন? তা না হলে বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে বলতো না তারা।’ তিনি বলেন, অনৈতিকভাবে খেলায় বিজয়ী হওয়ায় কোনো গৌরব নেই। খালেদা জিয়া বড় ফ্যাক্টর। তাকে বাদ দিয়ে দেশে গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের সুযোগ নেই।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি