২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | বিকাল ৩:৩১

অপসংস্কৃতির ভ্যালেন্টাইন’স

আজ ১৪ ফেব্রুয়ারী। কিছুদিন আগে থেকে আমাদের দেশে এ দিনটির নাম পাল্টে গিয়ে ভ্যালেন্টাইন’স ডে অথবা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নাম নেয়। ভ্যালেন্টাইন মানে কিন্তু ভালোবাসা না। ভ্যালেন্টাইন একজন ব্যাক্তির নাম। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হলে তা হত “ওয়ার্ল্ড লাভ ডে”। যেহেতু এক ব্যাক্তির নামে এই দিবসের নাম তাই তাঁর পেছনের একটু ইতিহাস আমাদের জানা প্রয়োজন।

ভালোবাসা দিবস সম্পর্কে অনেকগুলো মতামত পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি প্রসিদ্ধ মত হল রোম সম্রাট ক্লাডিয়াস এক সময় দেখল যে বিবাহিত সৈন্যদের তুলনায় যুবক সৈন্যদের অংশগ্রহণ ও অবদান বেশী। তাই যুদ্ধের সফলতা বাড়াতে তিনি বিবাহ বন্ধের হুকুম জারী করলেন। তৎকালীন খ্রিস্টান পাদ্রী ভ্যালেন্টাইন এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং তার তত্ত্বাবধানে যুবক যুবতীরা বিবাহ ছাড়াই একত্রে মিলিত হত।এমতাবস্থায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে জেলখানার রক্ষকের এক অন্ধ মেয়ের প্রেমে পড়েন সেই পাদ্রী। সে(পাদ্রী) ছিল চিকিৎসক। তার চিকিৎসার কারণে  কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েটি ভালো হয়ে যায়। মৃত্যুর আগে সেই পাদ্রী তার চিঠিতে লিখে যান, (ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন)।

আরেকটা মতামত অনুযায়ী, খ্রিস্টের জন্মের আরো প্রায় ৪০০ বছর আগে মানুষেরা বিভিন্ন ধরণের দেব-দেবীর পূজা করত। ফসলদাতা দেবতাকে বলা হত লুপারকালিয়া। সে যুগের লোকেরা লুপারকালিয়ার খুশির জন্য লটারী খেলার আয়োজন করত। খেলায় যুবতীদের নাম লেখে বাক্স ভর্তি করা হত। একে একে তুলা হত সেই বক্সে রাখা যুবতীদের নাম। লটারীতে যে মেয়ের নাম আসত সে সেই দিন অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ধরে পরবর্তী বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত লটারীতে আসা কোন এক যুবকের  সাথে মেলামেশা করত। লটারীর নির্ধারিত এক বছর সময় শেষ হলে তারা একটি পশু উৎসর্গ করত। উৎসর্গকৃত পশুর চামড়াটা ঐ যুবতীকে পড়ানো হত। এবং উৎসর্গকৃত পশুর রক্ত এবং কুকুরের রক্ত একসাথে মিশিয়ে চাবুকের গায়ে লাগিয়ে তা দিয়ে আঘাত করতে করতে ঐ যুবতীকে হত্যা করা হত। আর বলা হত এরা অভিশপ্ত সৃষ্টি। এদের জন্য এটাই প্রকৃত শাস্তি।

প্রিয় পাঠকেরা, একটিবার চিন্তা করে দেখুন তো, আমরা যে ভালোবাসা দিবস পালনের জন্য এত ঝাঁকঝমকপূর্ণ আয়োজন করি এর মাধ্যমে আমরা মূলত কেমন এক অপসংস্কৃতির লালন করছি।

একটিবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি? যে পানির অপর নাম জীবন তা কেন মাঝে মাঝে আমাদের কাছে মরণ হয়ে আসে? যে ড্রাগ ব্যবহারে আমাদের রোগ আরোগ্য লাভ করে তা কেন আমাদের কাছে মাঝে মাঝে মৃত্যুর কারণ হয়? যে খাবার আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে তার থেকে কেন অনেক সময় আমাদের জীবননাশ হয়? এগুলোর একটাই উত্তর আসে। তা হল নির্ধারিত সীমা পেরিয়ে সীমা লঙন করলে এমনটি ঘটে।

মানব সৃষ্টির অন্যতম একটা কারণ হল নারী-পুরুষের একে অপরের মাধ্যমে পরিতৃপ্তি লাভ করা। এটি মানুষের মৌলিক জৈবিক চাহিদা। আর এই অন্বয়ের জন্যও আছে সুনির্ধারিত নীতিমালা ও নির্ধারিত সীমা পরিসীমা। যে বন্ধনের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী একটি সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হয় যাকে আমরা বিবাহ বলে থাকি এবং এর মাধ্যমে আমরণ পরস্পর পরস্পরের জন্য সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। যেখানে তারা খুঁজে পায় জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দের অনুভূতি। সমাজ পায় একটি সুশিক্ষিত জাতি যা নৈতিকতার বলয়ে আবিষ্ট বিবাহের মাধ্যমে গড়ে উঠে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান তথা পরিবার। কথিত ভালোবাসা দিবসে আমরা তাহলে কি হারাচ্ছি সেটা ভেবে দেখার বিষয়।

আমাদের দেশে সদ্য আমদানিকৃত এই দিবসের বৈশিষ্ট্য হল, এদিন আমাদের দেশের তরুন তরুনীরা সকাল থেকে ঘরের বাইরে বের হয়ে যায়। তার পর ঘুরতে যাবার জন্য বেছে নেয় পছন্দের একটি মানুষ। প্রকাশ্য দিবালোকে অবাধ মেলামেশার লাইসেন্স পায় তারা। সারাটা দিন অপরিমেয় প্রণয়ে লিপ্ত হয়। ক্ষনিকের এই ভালোবাসা খেলাখেলির ছলে আটকা পড়ে যায় অগনিত তরুন তরুনীরা। অবৈধ প্রনয়ের দিকে পা বাড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কর্মস্পৃহার আগ্রহ।  সাময়িক ভাবে মনে হওয়া এই ভালো সম্পর্কটি একদিন রূপ নেয় আত্মঘাতী হরেক রকমের সিদ্ধান্তের। এমন পথে পা বাড়িয়ে জীবন নষ্ট করে নিম্নমানের জীবনোপভোগ করা ছেলেমেয়ের সংখ্যা চোখে পড়ার মত। দৈনন্দিন ঝগড়া একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিনত হয়। কোন কোন পর্যায়ে তারা আত্মহত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

এমনটি না হয়ে যদি বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হয় তাহলেও তারা একে অন্যের প্রতি বিশ্বাস করতে পারে না। এটি যদি প্রণয়ে লিপ্ত দুজনে বিবাহ করে অথবা তা হয় ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন প্রণয়লিপ্তদের মাঝে তাও একই অবস্থা হয়। বিবাহ পরবর্তী জীবনে তারা ঝগড়াটাকেই প্রতিদিনের কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করে। যেহেতু সন্তানের পর্যাপ্তভাবে বেড়ে উঠার জন্য পরিবার একটা সামাজিক সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান সেহেতু আমাদের ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে উঠে ঝগড়াপূর্ণ এমন একটি পরিবেশে যার মাঝে শুধুই কলহ থাকে। মানসিকভাবে বিকশিত হতে না পারা এই শিশুদের সংখ্যাটা দিনদিন বেড়েই চলছে।

সংস্কৃতি আমাদের লালন করে। আমরা সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকি। সভ্যতা বিকাশের উপাদান হল সংস্কৃতি। সংস্কৃতি পালনে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আমরা এমন কোন সংস্কৃতিকে আমদানী করছি না তো যা আমাদের নীতি নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে? তাই আজকের দিনে আমাদের সমাজে ভালোবাসা দিবস নামে যে অসভ্য সংস্কৃতির নোংরা অনুশীলন পালন করা হচ্ছে তা আমাদের সমাজের ভিত্তিটাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। সুন্দর, সুস্থ্য ও একটি কাঙ্ক্ষিত জাতিসত্ত্বার জন্য সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কারী এই ভালোবাসা দিবসের উদযাপন বন্ধ করা আমাদের সবার নাগরিক দায়িত্ব। ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন’স ডে এর সঠিক ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।

মো. তরিকুল ইসলাম

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

প্রকাশ :ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৮ ৭:৩৮ অপরাহ্ণ