নিজস্ব প্রতিবেদক:
‘ক্রিকেট খেলার কথা বলে প্রতিবেশী নয়ন মামা আমাকে গল্লামারি যেতে বলে, আমি তার কথামত অটোতে (ইজিবাইক) করে গল্লামারি যাই, সেখানে আগে থেকেই নয়ন অপেক্ষা করছিল। আমি যাওয়ার পর নয়ন আরেকটি অটো নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে রিয়াল ভাইয়াকে উঠায়। কৈয়া ব্রীজ এলাকায় গিয়ে অটো পরিবর্তন করে। সেখান থেকে আবারও অটো নিয়ে কৈয়া ব্রীজ পার হয়ে মাঝের ভেরি নামক এলাকায় রিয়ালের নানার ঘেরে নিয়ে যায়। সেখানে একটি ঘেরের বাসায় তাকে বসতে দিয়ে ফোন করে রিয়ালের এক মামাকে ডেকে আনা হয়। এরপর তারা তিনজন বাইরে বসে কি যেন খায়। এ সময় সে চলে আসতে চাইলে তারা অস্ত্র বের করে গুলি করে হত্যার ভয় দেখায়। নয়ন বলে, তুই যেতে পারবি না, আর এখানে যা হবে তা কাউকে বললে তোকে এবং তোর বাবাকে গুলি করে মেরে ফেলবো- এ কথা বলার পর নয়ন ঘরে এসে আমার সঙ্গে খারাপ কাজ করে। এরপর রিয়াল এবং তার মামা এসেও খারাপ কাজ করে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর যাতায়াত ভাড়া হিসেবে ১শ’ টাকা দিয়ে আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়’ ।
গণধর্ষণের উল্লিখিত বিস্তারিত বর্ণনা খুলনার একজন ক্রিকেটার কিশোরীর (১৪)। সে নগরীর নিরালা সংলগ্ন ২ নম্বর কাশেম নগর এলাকার বাসিন্দা এক নিরাপত্তা প্রহরী কন্যা। নগরীর বানরগাতির একটি এনজিও স্কুল থেকে এবার অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে সে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিসহ বিভিন্ন পুরস্কারও পেয়েছে সে। কিন্তু তিন ধর্ষকের পাপের ফসল এখন তার গর্ভে। প্রায় সাড়ে তিন মাসের অন্তসত্বা সে। অসহ্য যন্ত্রণা এবং লোকলজ্জার ভয়ে মাতৃহারা এ তরুণীর জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। সে এখন আর প্রিয় খেলা ক্রিকেটের দিকে ছুটতে পারছে না। মৃত্যু হয়েছে সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান একটি প্রতিভার।
এদিকে, ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর ওই কিশোরীর বৃদ্ধ বাবা বাদি হয়ে রোববার খুলনা সদর থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ধর্ষক মোস্তাফিজুর রহমান নয়নসহ তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। অভিযুক্ত নয়ন নগরীর নিরালাস্থ ২ নম্বর কাশেম নগর লেন এলাকার ইট-বালু ব্যবসায়ী বজলুর রহমানের ছেলে। বাবা বজলুর রহমান স্থানীয় ২৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক, ওয়ার্ড পুলিশিং কমিটির সদস্য এবং ২নম্বর কাশেম নগর জনকল্যাণ সমিতির সভাপতি।
ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাবা জানান, তার তিন কন্যার মধ্যে বড় দু’ জনের বিয়ে দিয়েছেন। তারা স্বামীর সংসারে থাকে। এরই মধ্যে গত কুরবানির ঈদের পর তার স্ত্রী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এরপর থেকে তিনি ছোট মেয়েকে নিয়ে কাশেম নগর এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, তার ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো। পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতো। সে বিভিন্ন স্থানে খেলায় অংশ নিয়ে অনেক কাপ এবং মেডেলও পেয়েছে। যে কারণে এলাকার সবাই তাকে উৎসাহ দিত। তিনি আরও বলেন, নয়ন তাদের প্রতিবেশী হওয়ায় তার মেয়ে তাকে ‘মামা’ এবং রিয়ালকে ‘ভাই’ ডাকতো। কিন্তু নয়নসহ তিনজন তার মেয়েকে ক্রিকেট খেলার কথা বলে কৈয়ারবিলে একটি ঘেরের বাসায় নিয়ে সর্বনাশ করেছে। তিনি ধর্ষকদের বিচার দাবি করেন।
রোববার বিকেলে সরেজমিনে কাশেম নগর এলাকায় গিয়ে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার মেয়েটি ধর্ষকদের হত্যার হুমকির ভয়ে পুরো বিষয়টি চেপে রাখে। সে ওই ঘটনা কাউকেই বলেনি। কিন্তু সম্প্রতি তার চলাফেরায় এক ধরণের পরিবর্তন স্পষ্ট হলে বাড়ির অন্য নারীরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক পর্যায় সে বিষয়টি স্বীকার করে। এ সময় তার ডাক্তারী পরীক্ষায়ও অন্তসত্বার বিষয়টি ধরা পড়েছে বলে প্রতিবেশিরা জানিয়েছেন।
এদিকে, ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর অভিযুক্ত নয়নের বাবা আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান শুক্রবার রাতে জনকল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সরদার, এ্যাড. উজ্জল, ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল করিম সবুজ, প্রাক্তণ ব্যাংকার হাফিজুর রহমান এবং শেখ শাহজালালসহ কয়েকজনকে নিয়ে গোলাম মোস্তফার বাড়িতে যান। সেখানে তারা শালিসের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার জন্য কিশোরীর বাবাকে প্রস্তাব দেন। কিশোরীর তখন বাবা ধর্ষক নয়ন কর্তৃক তার মেয়েকে বিয়ে এবং দেনমোহর (কাবিননামা) বাবদ ৫ লাখ টাকা প্রদানের শর্তে বিষয়টি মিমাংসা করতে রাজি হন।কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান শুধুমাত্র ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। যে কারণে মিমাংসার উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
বিষয়টি স্বীকার করে অভিযুক্ত নয়নের বাবা আওয়ামী লীগ নেতা বজলুর রহমান ছেলের পক্ষে ছাপাই গেয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওই মেয়ে এলাকায় প্যান্ট-শার্ট করে ছেলেদের মত চলাচল করে, দেখলে তাকে ছেলে মনে হবে, আর ক্রিকেট খেলে। তার কারণে এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, যে কারণে মেয়েকে অন্য জায়গায় রেখে আসতে বলা হলেও তার বাবা শোনেনি। এখন তার ছেলেকে জড়িয়ে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হচ্ছে। বিষয়টি মীমাংসার জন্য তিনি এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন বলেও উল্লেখ করেন।
খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমএম মিজানুর রহমান রোববার রাতে এ প্রতিবেদককে বলেন, এ ঘটনায় থানায় একটি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে, আসামিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুত আসামিকে গ্রেফতার করা হবে।
উল্লেখ্য, নয়নের বন্ধু অপর ধর্ষক রিয়াল নগরীর নিরালা প্রান্তিক এলাকার জনৈক ফজরের ছেলে। ঘটনা প্রকাশের ভয়ে সম্প্রতি সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে, অপর ধর্ষক তার মামা’র পরিচয় কেউ জানাতে পারেনি।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ