বিনোদন ডেস্ক:
মাত্র ১২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘বৈষম্য’। নির্মাণ বা অভিনয়ে নেই বিশেষত্ব। কিন্তু বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। অনেকে নির্মাতাকে আইনের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন। হায়াত মাহমুদ রাহাত পরিচালিত ছবিটির প্রধান দুই চরিত্রে আছেন সাব্বির অর্ণব ও খান সুব্রত। এতে দেখা যায়, এক তরুণীর প্রকাশ্যে ধূমপানে প্রতিবাদী হয়ে উঠে এক তরুণ। তবে ধূমপানের অপকারিতা বা ছেলেদের ধূমপান নিয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই! উল্টো মেয়েদের ধূমপানের ছবি ভিডিও করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার প্ররোচনা দেওয়া হয়।
‘বৈষম্য’ নিয়ে কবি ও চিন্তক ব্রাত্য রাইসু একসারি স্ট্যাটাস দেন ফেসবুকে। তিনি লেখেন— “বৈষম্য’ আপনাদের না করছে, সে কারণেই যেন সিগারেট ধইরেন না। সিগারেট মৃত্যু ডাইকা আনে। সিগারেট ছাইড়া দেন।“বাংলার নরদের যে কী দুর্দশা তা ‘বৈষম্যে’ নিবেদিত লাইকের সংখ্যা দেইখা বোঝা যাইতে পারে। নারীরা বেটার, আমার তাতে কোনো সন্দেহ নাই।” “বৈষম্য’ শর্টফিল্মটিকে কেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে না? আইন বিরোধী মতামত সম্প্রচারকে কী কারণে আইনের আওতায় আনা হবে না?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েন লেখেন, “সাব্বির অর্ণব নামে একজন একটি ভিডিও ছেড়েছেন। বিষয় হলো, মেয়েরা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারবে না। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। সেটা জেনেও কেউ যদি ধূমপান করেন সে দায় তার, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনে জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছে ‘মেয়েরা প্রকাশ্যে ধূমপান করতে পারবে না’ বলে। সমস্যাটা মেয়েদের প্রকাশ্যে ধূমপান করার। যদিও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এই জিহাদকারীর সব বন্ধুরাই ধূমপায়ী, তবে সেটা তার কাছে কোন সমস্যা না। মেয়েরা করতে পারবে না, ব্যস। যেহেতু তিনি চেয়েছেন। সে’জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হচ্ছে সে থেকে এই নির্মাণকারীর দৌঁড় বোঝা যায়। আমাকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করেছে যা, তা হলো, মেয়েদের প্রকাশ্যে ধূমপান থেকে বিরত রাখার জন্য তাদের ধূমপানরত ছবি তুলে নেটে ছড়িয়ে দেয়া। এবং দেখা যাচ্ছে ছেলেরা দলবদ্ধ হয়ে মেয়েদের যেখানেই ধূমপান করতে দেখছে সেখানে গিয়েই ভিডিও সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
এই নির্মাতা বোধহয় জানেন না, এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। যে কারো ছবি বিনা অনুমতিতে তোলা অপরাধ। সেই ছবি ভাইরাল করা আরো অপরাধ। মেয়েদের উপর দলবদ্ধভাবে চড়াও হয়ে তাদের ছবি তোলা অপরাধ এবং হুমকি দান করা অপরাধ। উপরন্তু, সেসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে তাদের হেনস্তা করার প্রকাশ্য ডাক কেন নারী নির্যাতন বলে গণ্য করা হবে না? আমি এই ভিডিওনির্মাণকারী এবং প্রকাশকারী অর্ণব সাত্তারের বিচার দাবি করছি দেশের প্রচলিত নারী নির্যাতন আইনে।”
নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের ভাষ্য— “নারীদের প্রকাশ্যে ধূমপান করা নিয়ে ফেসবুকে একটা অতি কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখলাম। সেটা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়াও দেখছি। যারা ভিডিওটি বানিয়েছেন তারা চেয়েছেন আলোচনায় আসতে পেরেছেনও। ভিডিওটির একটা জায়গায় বলতে শুনি ‘আমি পারবো এই পার্কের মধ্যে আমার উপরের জামা খুলে হাঁটতে, আপনি মেয়ে হয়ে সেটা পারবেন?’ তরুণ প্রজন্মের একজন পুরুষের এহেন দৃষ্টিভঙ্গি মানুষ হিসাবে আমাকে শংকিত করে!
এতো কষ্ট করে পোশাক আবিস্কার করা হলো, পুরুষকেই বা কেন নগ্ন হয়ে ঘুরতে পারার কৃতিত্ব নিতে হবে! পুরুষ কি তবে এখনো সভ্যতার আলো পায়নি, তাই নগ্ন হতে পারাটাকে একধরনের পুরুষালী বিজয় মনে করছে? তো উত্তেজিত ছোট্ট ভাইয়াটি তুমি যেহেতু মনে করছ তোমার পার্কের ভেতরে টি শার্ট খুলে হাটতে পারার মতো দুর্লভ ক্ষমতা আছে, তুমি প্যান্টও খুলে ফেল, তুমি তো পুরুষ, তোমার আর পার্কের নেড়ি কুত্তার মধ্যে পার্থক্য রাখার কী দরকার! (তবে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন যিনি তাকে বাহবা দিতেই হয়, উনার একবারও মনে হলো না— এইরকম চরম অবমাননাকর একটা চরিত্রে আমি কেন অভিনয় করবো!)”
নির্মাতা তাসমিয়াহ আফরিন মৌ লেখেন, “ভাই ও বোনেরা, এ সকল বীরপুরীষরা তো পর্নও বানায়, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির বিজ্ঞাপনও বানায়। এদের এক কাতারে নিয়া বিচার চান। বাই দা ওয়ে, পুরাটুকু দেখতে পারলাম না। ডাস্টবিনের সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না।” লেখক শোয়েব সর্বনামের ভাষ্যে— ‘তামাক আফিম বিড়ি জর্দ্দা এইসকল নেশা এই অঞ্চলে মূলত নারীদের নেশা। লেট এইটিজ পর্যন্তও মহিলারা ঘরে বইসা বিড়ি খাইতো। ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ সিনেমায় দেখা যায় নারীরা বিড়ি খাইতে খাইতে বচসা করতেছেন। সেই আমলে পুরুষের নেশা হিসেবে ব্যবহৃত হইতো হুক্কা।
সহজলভ্যতার কারণেই সম্ভবত মধ্যবিত্ত নারীদের হাত থেকে বিড়ি কাইড়া নিতে পারছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কিন্তু এখনও বড়লোক ও গরীব, আদিবাসি ও পাহাড়ি নারীদের মধ্যে বিড়ির ব্যাপক প্রচল বিদ্যমান। ‘বৈষম্য’ শর্টফিল্মে বিড়ি খাওয়া নারীদের খারাপভাবে উপস্থাপন করার এই টেন্ডেন্সি সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তি পাওয়া ‘ডুব’ সিনেমাতে ছিল। আমাদের সিনেমার দর্শকেরা তখনো সেইটা নিয়া কথা বলার দরকার মনে করেন নাই।
‘বৈষম্য’ সেই আলাপ তুলতে পারছে, এইটাই সার্থকতা। ‘বৈষম্য’ একটি বিপ্লবী মুভি, একে সমর্থন করুন।” ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার কাহিনীর সানী সানোয়ার এ বিষয়ে দীর্ঘ পোস্ট দেন। একাংশে লেখেন, “গোড়াতে যদি গলদ থাকে তাহলে শিল্পচর্চা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে তার স্পষ্ট উদাহারণ এই ‘বৈষম্য’ নামের ইউটিউব ভিডিওটি। প্রায় ১২ মিনিটের এই ছোট্ট নাটিকাতে লেখক মনের অজান্তে একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র নারী সমাজকে জড়িয়ে ফেলেছেন। আমার ধারণা এরকম অসংখ্য ভিডিও অনলাইনে রয়েছে যেগুলোর কোন শিল্পগুণ বা যৌক্তিক ভিত্তি নেই। অথচ, এগুলো লাখোলাখো ভিউয়ারস দেখছে এবং সেগুলো থেকে অনেকের কাছে ভুল ম্যাসেজ যাচ্ছে কিংবা সেগুলো থেকে ভুল শিক্ষা নিচ্ছে।”
দৈনকদেশজনতা/ আই সি