বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৯১টি দেশের ১৬০০ শহরের মধ্যে পরিবেষ্টক বায়ু দূষণের দিক থেকে সবচেয়ে দূষিত ২৫টি নগরীর মধ্যে বাংলাদেশের তিনটি নগরী (ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ) রয়েছে। বায়ু ও ধুলা দূষণের বর্তমান হার অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা ও চট্রগ্রাম মহানগরীসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকে বেইজিং, দিল্লী, তেহরান, প্যারিসের মতো ধুলা দূষণজনিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। এদিকে, বিষাক্ত বায়ু কীভাবে ছোট শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে উত্থাপিত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে বায়ু দূষণ কমাতে অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছ ইউনিসেফ। চলতি মাসে প্রকাশিত ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক বছরের কমবয়সী প্রায় ১৭ মিলিয়ন শিশু এমন এলাকাগুলোতে বসবাস করে, যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমার চেয়ে অন্তত ছয় গুণ বেশি। যার ফলে তাদের বিষাক্ত বায়ুতে শ্বাস নিতে হয়, যা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ঝুঁকিতে ফেলে। এসব ছোট্ট শিশুর তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ ১২ মিলিয়ন (১ কোটি ২০ লাখ) দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়া হলে তা সুনির্দিষ্টভাবে মস্তিষ্কের টিস্যু এবং জ্ঞানের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে; যার বিরূপ প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বলেন, ‘দূষণ শুধু শিশুর ফুসফুসের গঠনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, এটা স্থায়ীভাবে তাদের মস্তিষ্কের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যতকেই ক্ষতির মুখে ফেলে। বায়ু দূষণ থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখা গেলে তাতে শুধু তাদেরই উপকার নয়, স্বাস্থ্যসেবা খরচ সাশ্রয় ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর উপকারিতা পায় সমাজও এবং প্রত্যেকের জন্য তৈরি হয় একটি নিরাপদ-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।’ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবনের প্রথম সংকটময় এক হাজার দিনে অপর্যাপ্ত পুষ্টি, উদ্দীপনা ও সহিংসতার মতো বায়ু দূষণও শিশুদের মস্তিষ্কের প্রারম্ভিক বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে শৈশবের বিকাশে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
এতে আরো বলা হয়েছে, বাতাসে অতিসূক্ষ্ম দূষণ কণাগুলো এতোই ছোট যে, সেগুলো রক্তপ্রবাহে ঢুকে পড়তে পারে, মস্তিষ্কে চলে যেতে পারে এবং ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ারকে নষ্ট করে দিতে পারে; যা স্নায়ু প্রদাহের সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিবেদনটির আলোকে অধ্যাপক ডা. গোলাম মাঈনউদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে, অতিসুক্ষ্ম ম্যাগনেটাইটের মতো কিছু দূষণ কণা ঘ্রাণজনিত স্নায়ু এবং তন্ত্রের মাধ্যমে শিশু শরীরে প্রবেশ করতে পারে যা নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের কারণ। এ ছাড়া পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনের মতো অন্য ধরনের দূষণ কণাগুলো মস্তিষ্কের এমন অংশের ক্ষতি করতে পারে, যেসব অংশ মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে ও শিশুদের শিক্ষা এবং বিকাশের ভিত্তি রচনা করে।
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং শিশু ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, একটি ছোট্ট শিশুর মস্তিষ্ক অত্যন্ত নাজুক, কেননা প্রাপ্তবয়স্ক একজনের মস্তিষ্কের তুলনায় খুব অল্প পরিমাণে বিষাক্ত রাসায়নিকেই এটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রেও শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকে। কারণ তারা অনেক দ্রুতশ্বাস নেয় এবং তাদের শারীরিক প্রতিরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিকশিত থাকে না। শিশুস্বাস্থ্য বিভাগে রোগীর প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে ভর্তি হচ্ছে। এমন তথ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে শিশু সুরক্ষার উপায় সম্পর্কে ডা. লেলিন বলেন, ধুলা ও বায়ু দূষণ রোধের কোনো বিকল্প নেই। প্রথমেই সরকারিভাবে এর উৎসগুলো বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। দিনের যে সময়ে বায়ু দূষণ সবচেয়ে কম থাকে সেই সময়ে শিশুদের চলাফেরা করানোর মাধ্যমে তাদের দূষণের মুখোমুখি হওয়া কমাতে হবে। বাসা-বাড়ি যাতে ধুলা দূষণ মুক্ত থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর রাস্তায় বের হলেই ছোট বড় সবার ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
দৈনিকদেশজনতা/ আই সি