নিজস্ব প্রতিবেদক:
দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধান বিলুপ্তির পথে। আর বিলুপ্তপ্রায় দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধান ফিরিয়ে আনতে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষাবাদ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর অঞ্চল প্রথমিক অবস্থায় এবছর মাঠ পর্যায়ে শুরু করেছে এ ধান চাষ। পেয়েছেনও আশাতীত ফলন। ফলন দেখে আগামীতেও এ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষক।
কাটারি ধান উৎপাদন কম হওয়ায় এবং ভালো দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক এ বিশেষ জাতের ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তবে প্রথমবারের মতো উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষে ব্যাপক সাফল্য বয়ে এনেছেন কৃষক। পেয়েছেন আশাতীত ফলন। ফলন দেখে আগামীতেও এ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষক।
কখন, কীভাবে দিনাজপুর জেলায় কাটারিভোগ ধানের চাষ শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, কাটারিভোগ দিনাজপুরের আদি ধান। আর্যদের আগমনের আগে থেকেই এ অঞ্চলে এ ধান উৎপন্ন হতো। কাটারিভোগ চাল মাথার দিকে ছুরির মতো একটুখানি চোখা ও বাঁকা। যেমন সুগন্ধি, তেমনি খেতেও সুস্বাদু।
এ ধানের চিড়া হয় হালকা ধবধবে সাদা ও এতে আছে মিষ্টি সুগন্ধ। কাটারিভোগ ধানের আতপ চালের পোলাও জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
আদিকাল থেকে কাটারিভোগ অভিজাত শ্রেণির আচার অনুষ্ঠানে স্থান পায়। আজও দিনাজপুরের কাটারিভোগ সুগন্ধি চাল দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নে সুনাম বজায় রেখেছে। এ চালের পোলাও ছাড়া বিরিয়ানি, জর্দা, পায়েশ ও ফিরনি বেশ চমৎকার ও সুস্বাদু-যা জিভে জল আনে। দাম বেড়ে গেলেও এখনও দিনাজপুরের কৃষকরা লক্ষ্মী-নারায়ণ পূজায় এবং মসজিদে মিলাদে এই চাল ব্যবহার করে থাকেন। আর্যদের আগমনের আগে থেকেই দিনাজপুরে কাটারিভোগ ধানের চাষ হয়ে আসছে।
কথিত আছে, দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে রাজাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে। রাজা প্রাণনাথ সম্রাটের সঙ্গে দেখা করতে হীরা, পান্না, স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও কাটারিভোগ চাল সঙ্গে নিয়ে যান। সম্রাট হীরা, পান্না উপঢৌকন হিসেবে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে। এই খুশিতে সম্রাট প্রাণনাথকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯১২ সাল থেকে এ জাতের ধান দিনাজপুর জেলায় চাষাবাদ হচ্ছে। দিনাজপুর অঞ্চলের বিশেষ জাতের এই ধান অন্য জেলায় চাষ হলেও সুগন্ধ ও স্বাদের তারতম্য হয়। এ কারণে এটি শুধু এই জেলায় ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে পরিচিতি আছে যুগ যুগ ধরে।
১৯৬৮ সালের দিনাজপুরের বন্যা এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের পর কাটারিভোগ ধানের বীজ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পরপরই ফিলিপাইন থেকে আগত ধান গবেষক মি. মালাপাতি এ ধানের উপর গবেষণা করে কাটারিভোগের সঙ্গে ফিলিপাইনে সরু ধানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন জাতের ফিলিপাইন বিআর ১১ উদ্ভাবন করেন। এ ধানের জন্যও উঁচু জমির প্রয়োজন। রাসায়নিক সারও দরকার হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধানের মত সুগন্ধ থাকে না।
আবার দিনাজপুরের সব এলাকাতেও কাটারিভোগ ধান চাষাবাদ হয় না। দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাশিলাহাট, ছোট বাউল, বড় বাউল, করিমুল্যাপুর, খানপুর, চিরিরবন্দর উপজেলায় কাউগাঁ, বিষ্টপুর, তালপুকুর মুকুন্দপুর, দুর্গাডাঙ্গা ও ভিয়াইল, পশ্চিম বাউল এবং কাহারোল উপজেলার দু-একটি উঁচু জায়গা এ বিশেষ জাতের ধান চাষ হয়। উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটি এ ধান আবাদের উপযোগী।
ফাশিলা হাট ও বাউল এলাকার কৃষক মজিবর জানান, কাটারিভোগ ধান চাষের জন্য নির্ভেজাল গোবর সার প্রয়োজন হয়। তবে গোবর সার অপ্রতুল হয়ে পড়ায় বিপাকে রয়েছেন চাষিরা।
কৃষকরা আরও জানান, কাটারিভোগ ক্ষেতে গোবর সার ফেললেও পার্শ্ববর্তী ক্ষেতের রাসায়নিক সারের প্রভাবে ঘ্রাণ ও গুণগত মান বজায় রাখা যায় না। কাটারিভোগ অন্যান্য ধানের তুলনায় কম হয় আবার কাটারিভোগ চাষে অনেক বেশি পরিশ্রমও হয়। বীজ বাছাই থেকে শুরু করে ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত অত্যাধিক পরিচর্যা করতে হয়। পরিচর্যা করে ঘরে ফসল তুললেও দাম মেলে সাধারণ ধানের মতোই যার ফলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুরে ২০১৪-১৫ সালে ৫৩ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে সুগন্ধি ধানের আবাদ হয়। ধান উৎপাদন হয় ১ লাখ ২২ হাজার ৩৮৯ টন। তার মধ্যে কাটারিভোগ আবাদ হয়েছিল ১ হাজার ২৬৩ হেক্টর জমিতে। ধান উৎপাদন হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৮ টন। ২০১৫-১৬ সালে জেলায় সুগন্ধি ধানের আবাদ বাড়লেও কমেছে কাটারিভোগ ধানের আবাদ। সুগন্ধিচাল ৫৩ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়। উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৮৪ টন। তার মধ্যে কাটারিভোগ ধান আবাদ হয়েছে ১ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এবছর ১ হাজার ২৫৭ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে। কিন্তু কাটারিভোগ ধানের আবাদ আরো কমেছে। মাত্র ২৫৪ হেক্টর জমিতে এর আবাদ হয়েছে। জমির পরিমাণের সঙ্গে সুগন্ধি ধানের উৎপাদন অনুপাত ১:৫।
কাহারোল উপজেলার চাষি আবদুল হান্নান, বাসেদ আলী ও রায়হানুল ইসলাম জানান, কাটারিভোগ ধান প্রতি একরে ২৫ থেকে ৩০ মণ আবার সাধারণ ধান উৎপাদন হয় ৩২ থেকে ৩৫ মণ। উৎপাদন ব্যয় বেশি এবং লাভ না হওয়ায় তারা এখন আর এ ধানের চাষ করছেন না। তবে সরকার এ চাল রপ্তানির উদ্যোগ নিলে ভালো বাজারমূল্য পাওয়া যাবে। তখন অনেক চাষি আবারো এ ধান উৎপাদনে এগিয়ে আসবেন বলে জানান তারা।
চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক রমজান আলী জানান, কাটারি সুগন্ধি ধান চাষে আগ্রহ হারানোর আরও একটি কারণ হলো, গুণগত মানের বীজ সংকট। দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের ঘরে তৈরি করা বীজ প্রক্রিয়ার জন্য আগের মতো সুগন্ধি জাতের ধানচাষে আশানুরূপ উৎপাদন হয় না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহ করা হলে সুগন্ধি জাতের ধানচাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়বে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, এখন জেলায় যেসব সুগন্ধি ধানের চাষ হচ্ছে, তারমধ্যে বাদশাভোগ, ফিলিপাইন কাটারি, সম্পা কাটারি, কালোজিরা, ব্রি-ধান-৩৪, ব্রি ধার-৭০, জিরা কাটারি, কালো জিরা অন্যতম। তবে এখন ব্রি-৩৪ ধান এবং ব্রি ধান-৭০ হেক্টর প্রতি সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায়। সে তুলনায় কাটারিভোগের উৎপাদন হার কম, ব্যয় বেশি। হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ১.৮৭৯ টন।
বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলে সুগন্ধি চালের উৎপাদনও অনেকাংশে বেড়ে গেছে। তবে স্থানীয় জাতের ধানের মতো সুগন্ধিযুক্ত হয় না। শুধু জৈব সারের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হলে সুগন্ধি চাল তার নিজস্ব সুঘ্রাণ ধরে রাখতে সক্ষম হয়।
দিনাজপুরের অনেক ব্যবসায়ী ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাটারিভোগ চাল বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল সাড়া পেয়েছেন। ১৯৮০ সালে টিসিবি কাটারিভোগ চাল রপ্তানির উদ্যোগ নিলেও অজ্ঞাত কারণে সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়।
দিনাজপুর চাল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোছাদ্দেক হুসেন জানান, স্থানীয় জাতের সুগন্ধি চাল তথা কাটারিভোগ ধান এখন বিলুপ্তির পথে। দিনাজপুরের ঐতিহ্য রক্ষা ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে কাটারিভোগ চাল ও চিড়া রপ্তানি করতে সরকারের পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
তবে বিলুপ্তপ্রায় দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধান ফিরিয়ে আনতে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষাবাদ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুর অঞ্চল প্রাথমিক অবস্থায় এবছর মাঠ পর্যায়ে শুরু করেছে এ ধান চাষ। পেয়েছেনও আশাতীত ফলন। ফলন দেখে আগামীতেও এ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কৃষক।
দিনাজপুরের অসংখ্য কৃষক এবার চাষ করেছেন উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০। এ জাতের ধান চাষ করে বিলুপ্তপ্রায় দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধানের চেয়ে দ্বি-গুণ ফলন পেয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় কৃষকের রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হলে নতুন করে আবারো জমিতে রোপা লাগালেও সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষাবাদে বন্যায় কোন ক্ষতি হয়নি রোপার। এ ধানে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ও রোগ-বালাইও কম।
এ ধানের ফলন দেখে অনেক কৃষক আগামীতে এ ধান লাগানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কৃষক আকরাম জানিয়েছেন, তিনি আমন ধানের যে রোপা লাগিয়েছিলেন, তা সাম্প্রতিক বন্যায় বিনষ্ট হয়ে যায়। পরে আবারো রোপা লাগাতে হয। কিন্তু কৃষক ফেরদৌস সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ লাগিয়ে বন্যায় কোন ক্ষতি হয়নি তার রোপার। ফলনও হয়েছে ভালো। তাই, তিনিও আগামীতে এ ধান লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার পুরিয়া গ্রামের কৃষক মতিউর রহমান প্রাথমিক অবস্থায় ৩ বিঘা জমিতে এবার উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ চাষাবাদ করেন। ধান ঘরে তুলে এ ধান দিয়েই তিনি নবান্ন করেছেন। বিঘা প্রতি তিনি ফলন পেয়েছেন ২০ থেকে ২২ মণ। এধানের চাল দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগের চাইতে আরো লম্বা। সুগন্ধ ভালো। খেতেও সুস্বাদু।
দিনাজপুরের শহরের বড়বন্দর এলাকার ঐতিহ্যবাহী চাল ব্যবসায়ী এ. কে. দাস জানান, কাটারিভোগে আগের ঐতিহ্য নেই। বর্তমানে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ এর সামান্য কয়েক মন চাল পেয়েছি। এর চালের চাহিদা বেশ রয়েছে। কাটারিভোগ চাল যেখানে বিক্রি হচ্ছে, ৭০ টাকা কেজি দরে ২৮’শ টাকা মণ। সেখানে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ এর চাল বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজি দরে ৩২’শ টাকা মণ। এ চাল দেখতেও সুন্দর। লম্বাটে। সুগন্ধি ভালো। আশা করা হচ্ছে, এ চাল ঐতিহ্যবাহী কাটারি ধানের চাহিদা পূরণ করবে।
জাতীয় বীজ বোর্ড থেকে ২০১৫ সাথে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারি ধানের বিকল্প কলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, রংপুর অঞ্চলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (প্রধান) ড.আবু বকর সিদ্দিক সরকার জানান, এধানে রোগ বালাইয়ের আক্রমণ কম। এ ধান উৎপাদন হতে সময় লাগে বীজ তোলা থেকে শুরু করে ফসল টাকা পর্যন্ত ১২৫ থেকে ১৩০ দিন। যা কাটারি ধানের চাইতে উৎপাদন সময় কম।
বিলুপ্তপ্রায় দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ ধান আবার মাঠ পর্যায়ে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট রংপুর অঞ্চল কাজ শুরু করেছে। ব্রি ধান-৭০ নামে এই ধান প্রাথমিকভাবে চাষাবাদ করে কৃষকরা ভালো ফলন পেয়েছেন। তাই আগামীতে এধানের চাষাবাদ বেড়ে যাবে এমনটাই মন্তব্য করেছেন কৃষিবিদরা।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ