২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং | ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | রাত ১২:৩৮

ফের ভয়াবহ দূষণের কবলে বুড়িগঙ্গা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বর্ষার পরপর বুড়িগঙ্গা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলেও আবার ভয়াবহ দূষণের কবলে পড়তে যাচ্ছে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার পরও বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্যে পানির রং আবার কালচে হতে চলেছে। তীব্র হচ্ছে কটু গন্ধ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মনিটরিং ও সচেতনতা বাড়াতে সরকারি তৎপরতা জোরদার করার দাবি নদীপ্রেমীদের।

ডিসেম্বরের শুরুতেই পানি যখন কমতে শুরু করে তখনই বুড়িগঙ্গায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে দূষণের চিত্র। এবার একটু দেরি হলেও ধীরে ধীরে দূষণের চিত্র প্রকাশ হচ্ছে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে সদরঘাটে বিভিন্ন রকমের মাছ পাওয়া গেলেও জালে গাদা গাদা আবর্জনাও উঠছে। বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে দায়ী করা হতো। এই শিল্প সরিয়ে নেওয়ার পরও বুড়িগঙ্গা আগের রূপেই ফিরে যাচ্ছে। কারণ সদরঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত দুই পাশ থেকেই নদীতে অনবরত ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য। তবে, আশার কথা হলো, এখনো নদীর ওপর বসছে অসংখ্য গাঙচিল।

ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার পর এই বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে যে আশার আলো দেখা দিয়েছে, তা নিভে যেতে বসেছে বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্যরে দূষণে। এসব কলকারখানার ইটিপিগুলো মনিটরিং করা গেলে এবং নদীকেন্দ্রিক সচেতনতা তৈরি করা গেলে আবার বুড়িগঙ্গাতেও প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব, মনে করছেন নদীপ্রেমীরা।

তারা বলছেন, রাজধানীবাসীর পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্য, হাজারীবাগের ট্যানারি খাল আর দূষণে ধুঁকছে বুড়িগঙ্গা। ৬২ ধরনের রাসায়নিক বর্জ্যে অনেক আগেই বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে আট ফুট পুরু পলিথিনের স্তর। নদীটির পানিতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ হাসপাতালের বর্জ্যও মিশছে। এমেক্সাসিলিন, পেনিসিলিন, সিপ্রোফ্লোক্সাক্সিন আর অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়েটিকও রয়েছে এর মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ ইত্যাদি হাসপাতাল-বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলার কারণেই অ্যান্টিবায়োটিক পানিতে মিশছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন অনেক কমে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে পানির গুণাগুণ। রাজধানী ঢাকার প্রাণরূপী বুড়িগঙ্গা এখন নগরবাসীর আবর্জনা ফেলার ভাগাড় মাত্র।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে মাছ ও জলজ প্রাণী বসবাসের জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। অপরদিকে দ্রবীভূত হাইড্রোজেন মাত্রা কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। অথচ বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোটায়। ফলে নদীর পানির গুণগতমানের অবনতি, মাছ ও জলজপ্রাণীর ক্ষতি, শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার অনুপযোগী এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বুড়িগঙ্গার চুনারচর, ভাড়ালিয়াপাড়া, মুগড়াকান্দা, উত্তর বাহেরচর, টোটালিয়াপাড়া, চরওয়াসপুর এলাকায় বড় আকারে ব্যাপকভাবে দখল হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রমতে, বর্ষাকালে এই নদীর পানি প্রবহমান থাকে। তবে বছিলায় সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও কিছু হাউজিং কোম্পানির দখলের কারণে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধলেশ্বরী থেকে আসা আদি বুড়িগঙ্গার মিলনমুখ। কিন্তু বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ‘দ্বিতীয় চ্যানেল পুনরুদ্ধারে’ গঠিত কমিটিকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর অস্তিত্ব রক্ষায় উৎসমুখ ও দ্বিতীয় চ্যানেলসহ পুরো নদী ভরাট ও নির্মাণকাজ বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া অবিলম্বে যথাযথভাবে সীমানা চিহ্নিত করে নদীটিকে বাঁচাতে হবে।

বাপার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মতিন বলেন, বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। সরকার বিভিন্ন সময় বুড়িগঙ্গা রক্ষায় প্রতিশ্রুতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও মাঝপথেই তা থেমে গেছে। কার্যকর সুফল আমরা পাইনি। ফলে প্রাণপ্রিয় বুড়িগঙ্গা আজ মৃত্যুর মুখে। কিন্তু ঢাকার জনগণকে বাঁচানোর স্বার্থে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। তাই বুড়িগঙ্গা রক্ষায় সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাপার বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক মিহির বিশ্বাস বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণে বিশেষ অবদানের জন্য ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করে তিনিই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।

দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ

প্রকাশ :ডিসেম্বর ১৩, ২০১৭ ৩:২৪ অপরাহ্ণ