নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠার বাসনায় প্রায়ই নতুন নতুন জোট ও উদ্যোগের কথা শোনা যায়। কিন্তু দুই দলকে এখন পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেনি কোনো শক্তি। এমনটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও কিংস পার্টি নামে পরিচিত দলগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এই বাস্তবতার মধ্যেও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট নামে নতুন একটি রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে যারাও তৃতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা বলছে।
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় আলোচিত পাঁচ রাজনীতিক সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কাদের সিদ্দিকী এবং মাহমুদুর রহমান মান্না জোট গঠনের উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে কামাল হোসেন বিদেশে থাকা অবস্থায় বাকি চার নেতা জোটের ঘোষণা দিয়েছেন সোমবার রাতে। জোটের শরিক দলগুলো হলো বিকল্পধারা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি),কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও নাগরিক ঐক্য।
এই নেতারা যখন জোট গঠনের উদ্যোগ শুরু করেছিলেন, তখন স্বাগত জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা। নতুন এই জোটের শীর্ষ নেতারা দেশজুড়ে আলোচিত হলেও তাদের নেতা-কর্মী সমর্থক দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমন বলা যাবে না। এই অবস্থায় তারা যে তৃতীয় শক্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত-এ নিয়ে কথা আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
জোটের অন্যতম অংশীদার নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, তৃতীয় শক্তি হওয়ার সম্ভাবনা জোরাল বলেই ভাবছেন তারা। মান্না বলেন, ‘দুইজোটের বিপরীতে নতুন একটা রাজনীতিক জোট গড়ার দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সাধারণ মানুষও সেটা চাইছে। আমরা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পুরণে পথ চলা শুরু করেছি। আমরা মানুষের কাছে যাব। আশা করছি দুই রাজনৈতিক জোটের বাইরে বৃহৎ শক্তি নিয়ে আমরা রাজনীতিতে আবির্ভূত হতে পারবো।’
যুক্তফ্রণ্টের আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির মহাসচিব আব্দুল মালেক রতন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি দুই রাজনীতিক জোটের বাইরে আমরা সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পুরণে ভুমিকা রাখতে পারব। এটি আরও আগে হইলে ভাল হতো।’
জোট জনমত গঠনে কী করবে-এমন প্রশ্নে এই নেতা বলেন, ‘সব জেলা, বিভাগীয় শহর এবং ঢাকায় বৃহৎ সমাবেশ করতে চাই আমরা। এসব করতে পারলে মানুষের মধ্যে বিশাল জাগরণ তৈরি হবে। আমরা আশা করছি মানুষ এটাকে ভালভাবে নেবো। দেশের মানুষ চাইছিল যে দুইজোটের বাইরে কোনো বৃহৎ জোট আসুক। সেইজন্য তৃতীয় জোটের একটি আকাঙ্খা ছিল। সেটি আমরা করতে পেরেছি।’
১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া পুরোটা সময় শাসন করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিভিন্ন নেতারা দাব করে আসছেন, দুই দলের বাইরে জনগণ বিকল্প খুঁজছে। তবে ভোটে কখনও এর প্রমাণ মেলেনি।
কেবল গণতান্ত্রিক সরকারের সময় নয়, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এই তৃতীয় শক্তির কথা বলে নানা চেষ্টা হয়েছিল। এর মধ্যে সে সময় তুমুল আলোচিত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল-পিডিপির এখন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ ইবরাহীম কিছু হবে না বুঝে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। আর গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মুহম্মদ ইউনূস তার দল ‘নাগরিক শক্তি’র দাঁড় করানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন সে আমলেই।
এই বাস্তবতায় নতুন জোট যুক্তফ্রন্ট রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারবে?- জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘যুক্তফ্রন্ট নামে নতুন জোট গঠন হয়েছে। এটি নিশ্চয়ই ভাল উদ্যোগ। তবে আমাদের দেশের ইতিহাসে বড় দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে অনেক জোটই হয়েছ। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি। নতুন এই কতটা সফল হবে সেটা নির্ভর করছে সাধারণ মানুষকে তারা কতটা আকর্ষণ করতে পারবে তার উপর।’
এক প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত বলেন, ‘তারা নির্বাচনী জোট না অন্য কিছু সেগুলো মানুষকে জানাতে হবে। তৃণমূল মানুষকে তাদের উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। এটি অনেক চ্যালেঞ্জ নতুন জোটের জন্য।’ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি মনে করি নতুন জোটের ফলে আমাদের সামনে বিকল্প বাড়বে। এতে করে ভোটারদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে বেশি। কারণ ভোটাররা তার সামনে অনেকগুলো বিকল্প পাবে। যত বেশি বিকল্প থাকবে ততোবেশি ভোটারদের জন্য ভাল হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, ‘তারা সফল হবে কি হবে না সেটা নির্ভর করছে তাদের কর্মকাণ্ড এবং আচরণের উপর। সবকিছুই সময় বলে দেবে।’ নতুন জোটকে স্বাগত জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘নতুন এই জোটকে স্বাগত জানাই। এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।’
যুক্তফ্রন্টকে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ আখ্যা দিয়ে কাদের এমনও বলেছেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন অনেক জোট, রাজনৈতিক নানা মেরুকরণ হবে। এটা খুবই স্বাভাবিক।’ জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘নতুন জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এখনো ঘোষণা হয়নি। সুতরাং এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী সেটি দেখব। তারা যদি গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতি করে দেশে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাগবে কথা বলে তাহলে আমরা নতুন জোটকে স্বাগত জানাব।’
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ