নিজস্ব প্রতিবেদক:
২০১৬ সালের ১১ মার্চ ময়মসনিংহের গফরগাঁওয়ের চৌকা গ্রামের এক তরুণীর সঙ্গে একই উপজেলার খিলগাঁও গ্রামের এক জনের বিয়ে হয়। কিন্তু সংসারে শান্তি আসেনি। অল্প দিনের মধ্যেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয় ঝগড়া বিবাদ। ফল বিচ্ছেদ। এক বছর যেতে না যেতেই সংসারে অশান্তি, ভরণ পোষণ না দেওয়া, সামান্য কারণে বকাবকি করা, অন্য নারীর সাথে পরকীয়ার অভিযোগ এনে স্বামীকে তালাক দেন তরুণীটি।
অল্প সময়ের মধ্যে সংসার ভেঙে যাওয়ার এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। ময়মনসিংহে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর সরকারি দপ্তর বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদের জন্য আবেদনকারী নারী। আর নির্যাতন, যথেষ্ট সম্মান না দেয়া, যৌতুক চাওয়াসহ নানা কারণ দেখিয়ে এসব আবেদন করা হচ্ছে।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ময়মনসিংহ জেলায় বছরে যত বিয়ে হয় তার চার ভাগের এক ভাগ আবেদন পড়ছে সংসার ভাঙার। এক হিসাবে দেখা গেছে জেলায় গড়ে প্রতিদিন ৫০টির বেশি বিয়ে হয়। আর ১৩টির বেশি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। ময়মনসিংহ জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জেলাটিতে গত এক বছরে ১৯ হাজার ৬৯২টি বিয়ে নিবন্ধিত হয়। আর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে চার হাজার ৮০৮টি।
রেজিস্ট্রারের দপ্তরের কর্মকর্তারা এও বলছেন যে, বিচ্ছেদের হার প্রতি বছর বাড়ছে। তবে গত বছরের আগের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান দিতে পারছেন না তারা। একই কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী গ্রামের তুলনায় শহরে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি। আবার প্রায় ৭০ শতাংশ বিচ্ছেদের আবেদন হচ্ছে নারীদের পক্ষ থেকে। জেলা কাজী (নিকাহ রেজিস্ট্রার) সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, উচ্চ ও মধ্যভিত্ত শ্রেণির মধ্যেই বিবাহ বিচ্ছেদ হার বেশি।
গফরগাঁও পৌর এলাকার ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের নিকাহ রেজিস্ট্রার নুরুজ্জামান জানান, শুধু তার আওতাধীন ছোট এই তিন ওয়ার্ডে ২০১১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ৪৮ জন গৃহবধূ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন। আর ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১৭ জন স্বামী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছেন।
বিচ্ছেদকারী একজন নারী বলেন, ‘এখন সমাজ পাল্টেছে। নারীরা এখন অধিকার নিয়ে সচেতন। আমাদের মা, নানীর প্রজন্মের নারীরা যা সহ্য করেছেন, আমরা তা সহ্য করবো না।’ চলতি বছরের ২ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার ধুলিহর গ্রামের যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণ হারিনা গ্রামের এক তরুণী। বিয়ের কদিন পরেই স্বাশী মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান আর তিনি স্ত্রী সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। আর স্বামী বিদেশে থাকা অবস্থায় শশুরবাড়ির লোকজনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত মেয়েটির ওপর। আর ১০ মাসের মধ্যে গত ৪ নভেম্বর স্বামীকে তালাক দেন তরুণীটি।
বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন অনুযায়ী সংসার জীবনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পুুরুষও। আর এ কারণেও ভাঙছে সংসার। ২০১৫ সালের ২০ জুন গফরগাঁওয়ের দৌলতপুর গ্রামের একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় একই উপজেলার এক ব্যক্তির। বিয়ের মাত্র দুই মাসের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ করেন স্বামী। ২০১৫ সালের ১০ আগস্টে বিচ্ছেদের আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, তার স্ত্রী তাকে মারধর করেন। তার স্ত্রী উচ্চাভিলাসী ও মুঠোফোনে পরকীয়ায় আসক্ত।
জাতীয় মহিলা পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদা বেগম বলেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকা ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। সাজেদা বেগমের মতে, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো পারিবারিক ও সামাজিক কাউন্সেলিং। তিনি বলেন, যে সমস্যার সমাধান আলোচনা বা ছাড় দিয়ে করা সম্ভব, সেটি কখনও বিচ্ছেদের দিকে নেয়া উচিত নয়। কারণ, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর।
সমাজবিজ্ঞানীরা এও বলছেন, স্বামীর মধ্যে চরম পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব আবার স্ত্রীর মধ্যে অতি উচ্চাকাক্সক্ষী মনোভাব-দুটোই ক্ষতিকর। এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোনের বিস্তার, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় থেকে মনের মধ্যে নতুন জেগে উঠা স্বাভাবিক। তবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষের থাকা উচিত।
সমাজতাত্তিকরা এও বলছেন, কোনো সমস্যা তৈরি হলে এ থেকে বের হয়ে আসতে স্বামী স্ত্রীর সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ। সংসারে কেউ ভুল করতে পারে, তাকে শোধরানোর সুযোগ দেয়া উচিত, আবার যাকে এই সুযোগ দেয়া হবে তার মধ্যে শোধরানোর মনোভাবও থাকা দরকার।
ময়মনসিংহ সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগীয় প্রধান জরিনা মজুমদারের মনে করেন, ব্যক্তিত্ব, নিজেদের মধ্যে বোঝাাপড়ার অভাব, আত্মঅহমিকা, একে অপরকে সময় না দেয়া- মূলত এসব কারণেই বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ থেকে বের হয়ে আসতে দুই পক্ষেরই উদার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ