নিজস্ব প্রতিবেদক:
এ বছরের ২০ অক্টোবর চাঁদাবাজির এলাকা ভাগ এবং অন্যান্য আন্তঃদলীয় কোন্দলের জেরে খাগড়ছড়ি জেলা সদরের কমলছড়ি ভুয়াছড়ির খ্রিস্টানপাড়ায় জেএসএস (এমএন) গ্রুপের নেতা সমায়ুন চাকমাকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে ইউপিডিএফ সদস্যরা।গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের (এমএন লারমা গ্রুপ) মধ্যকার বন্দুকযুদ্ধে যুদ্ধচন্দ্র চাকমা (২৯) ও নয়নজ্যোতি চাকমা (৩০) নামে নিহত হন জেএসএসের দুই সদস্য।
একই বছর ১৪ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার দাতকুপিয়া এবং ভুয়াছড়ি এলাকার মধ্যবর্তী স্থান কুতুকছড়িতে ইউপিডিএফ’র ১৫-২০ সদস্যের একটি গ্রুপ গোপন বৈঠক করছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে। যৌথবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অস্ত্রধারীরা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে যৌথ বাহিনীও গুলি ছুড়ে পাল্টা জবাব দেয়।এক পর্যায়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলটি অন্ধকার পাহাড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ইউপিডিএফের এক সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৩৮ রাউন্ড গুলিসহ যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি এম-১৬ রাইফেল, ১৯ রাউন্ড গুলিসহ একটি বিদেশী জি-৩ রাইফেল, একটি জি-৩ রাইফেলের ম্যাগজিন, ৪৯ রাউন্ড গুলিসহ একটি চাইনিজ সাব মেশিনগান, একটি চাইনিজ সাব মেশিনগানের ম্যাগজিন ও একটি ওয়াকিটকি সেটসহ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভ্রাতৃঘাতি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ নতুন নয়। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর অভ্যন্তরীণ কোন্দল তথা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে প্রাণ হারান উপজাতীয়দের প্রিয় নেতা ও জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা ওরফে এমএন লারমা।
এভাবে দীর্ঘ ৪ দশক ধরে প্রায় ঝরছে রক্ত ও প্রাণ।
১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৭ সালে চুক্তি সম্পাদনের আগ পর্যন্ত পাহাড়ে সেনা, পুলিশ, আনসার, ভিডিপি, সাধারণ পাহাড়ি-বাঙালি ও শান্তি বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে দাবি কয়েকটি সংগঠনের।
পার্বত্য চুক্তির মধ্য দিয়ে এই খুনাখুনি বন্ধ হওয়ার প্রত্যাশা করলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ হতাশ।
চুক্তির পর ইউপিডিএফ তাদের পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে থাকে। এ নিয়ে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত। ঝরতে থাকে রক্ত। বাড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্মি, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) ও আনসারসহ পাহাড়ি-বাঙালি নিহত হয়েছেন ২ হাজার ৩১৪ জন।
পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের পর ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৬৭৬ জন। আহত ১ হাজার ৩২৬ জন এবং অপহরণের স্বীকার হয়েছেন ১ হাজার ২৯৪ জন। নিহতদের মধ্যে ১৬ জন সেনা-পুলিশ, আনসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। ৪৭৪ জন উপজাতীয় এবং ১৮৬ জন স্থানীয় বাঙালি। আহতদের মধ্যে ৩৮ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। উপজাতীয় ৬৪৬ জন এবং বাঙালি ৬৪২ জন।
গোয়েন্দা সূত্রটি পার্বত্য চুক্তির আগের পরিসংখ্যান দিয়ে জানায়, ১৯৯৭ সালের আগে নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৮ জন। যার মধ্যে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ৩৪৩ জন। বাঙালি ১ হাজার ৫৭ জন এবং উপজাতি ২৩৮ জন।
সে সময় আহত হয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার। যার মধ্যে বাঙালি ৬৮৭ জন এবং উপজাতি ২৮১ জন।
সংস্থাটির হিসাব মতে বিভিন্ন সময়ে পার্বত্যাঞ্চলে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি পাহাড়ি-বাঙালি। এর মধ্যে চুক্তির পর অপহরণের শিকার হয়েছে ৯১০ উপজাতি এবং ৩৮৪ বাঙালি নাগরিক। আর চুক্তির আগে এ সংখ্যা ছিল বাঙালি ৪৬৪ জন এবং উপজাতি ২৭৪ জন।
এদিকে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্য চুক্তির পর বিভিন্ন সময় তাদের চার শতাধিক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। যার বেশিরভাগই ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষে। এসময় আহত হয়েছেন তিন শতাধিক নেতাকর্মী।
ইউপিডিএফের মুখপাত্র নিরবর চাকমা জানিয়েছেন, চুক্তির দুই দশকে তাদের তিন শতাধিক নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলায় নিহত হন।
অন্যদিকে জেএসএস (সন্তু) কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ও মুখপাত্র সজীব চাকমা বলেন, ‘এখন কতজন নিহত হয়েছে সেটা মুখ্য বিষয় নয়। এখন মূল ফোকাস হলো চুক্তি বাস্তবায়ন থমকে আছে। সরকার কায়েমি স্বার্থে চুক্তি অমান্য করে কাজকর্ম করছে।’
সরকার চুক্তিতে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন সজীব চাকমা। নতুন করে নিহতের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে তিনি অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে শান্তিচুক্তির পর থেকে তাদের ৯০ জন নেতাকর্মী প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হয়েছেন বলে আগে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সেটার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সেটা অপরিবর্তিত বলে এড়িয়ে যান।
এদিকে, চলতি মাসে আলাদা হওয়া খোদ ‘ইউপিডিএফ সংস্কার’-এর আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা অভিযোগ করে বলেন, গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বলপ্রয়োগের রাজনীতি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও অপহরণের রাজনীতি করছে প্রসিত বিকাশ খীসা। প্রসিত খীসা মুখে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত বন্ধের কথা বললেও সাম্প্রতিক সময়ে দশ জনের অধিক দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ এখন নীতিহীন, আদর্শহীন, লক্ষ্যভ্রষ্ট ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আর এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীদের আর্থিক দণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছেন তারা।
দৈনিক দেশজনতা/এন এইচ