নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী শহর থেকে পবা উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। কিন্তু এই গ্রামেই সবজির দাম শহরের তুলনায় অর্ধেক। সন্তোষপুরের চাষিরা অবশ্য নিজে শহরে সবজি নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন না। ক্ষেত থেকেই তাদের সবজি কিনে আনেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। ফলে শহরে সবজির দাম চড়া থাকলেও সে অনুযায়ী দাম পাচ্ছেন না প্রান্তিক চাষিরা।
রবিবার সকাল আটটার দিকে সন্তোষপুরে নিজের জমি থেকে শিম উঠাচ্ছিলেন কৃষক সেলিম রেজা। শিম কেনার জন্য জমির পাশেই অপেক্ষা করছেন পাইকারি ব্যবসায়ী ফুরকান আলী। সেলিম জানালেন, শিম বিক্রি করতে ফুরকানের সঙ্গে তার দর-দামও হয়ে গেছে। প্রতি কেজি ৬০ টাকা। অথচ রাজশাহী মহানগরীতে ওই শিম বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে।
পাশের ডাঙিপাড়া গ্রামে ক্ষেত থেকে কাঁচা মরিচ তুলছিলেন কয়েকজন নারী। তারা জানালেন, কয়েকদিন আগে তাদের ক্ষেতের মরিচ ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। তখন বাজারে মরিচের দাম ছিল ২০০ টাকা। এখন বাজারে কিছুটা দাম কমেছে। তাদের জমি থেকে মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা কেজি দরে।
গত কয়েক বছর ধরে শীত কিংবা গ্রীষ্মকালীন সবজিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন পবা ও পাশের মোহনপুর উপজেলার কৃষকরা। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে ফসলের মাঠ সবখানেই সবজি আর সবজি। এখন লাউ, মূলা, ফুলকপি, ঢেঁড়স, বাধাকপি, লালশাক, পালংশাক, পটল, পেঁপে, কলা, বেগুন, করলা, শসাসহ নানান সবজিতে ভরপুর দুই উপজেলা। এখানকার সবজি যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে।
মাঠে পাইকারি ব্যবসায়ীদের দেখা না পেলে পবা উপজেলার কৃষকরা চার চিটারের মোড়ে নিয়ে গিয়ে সবজি বিক্রি করেন। এখান থেকে সবজি পাইকারি দরে কিনে নিয়ে যান বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। তাই প্রতিদিনই বসে সবজির হাট। চার চিটারের মোড়ে গিয়ে দেখা গেল, শহরের তুলনায় এই সবজি বিক্রি হচ্ছে অর্ধেক দামে।
এখানে বেগুন ২৫ টাকা, ঢেঁড়স ২০ টাকা, শসা ২৮ টাকা ও করলা ৩০ টাকা কেজি দরে কিনছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। লেবু কেনা হচ্ছে প্রতি হালি ১২ টাকা। পালংশাক-লালশাক প্রতি আঁটি বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। ফুলকপি প্রতি পিস ২০ টাকায় আর প্রতি হালি কলা বিক্রি হচ্ছে ১২ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্তা পেঁপে (দুই মণ) বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। অথচ এসব সবজির কোনো কোনোটির দাম শহরে দ্বিগুণেরও বেশি। মধ্যস্বত্বভোগি পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে গ্রাম ও শহরের সবজির দামে সৃষ্টি হয়েছে এমন বড় ফারাক।
মোহনপুর উপজেলার বিদিরপুরেও সবজির পাইকারিহাট বসে প্রতিদিন। এই হাটেও সবজির দাম একই। হাটগুলোতে সরবরাহ বেশি থাকায় সবজির দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। তবে শহরের বাজারে বিক্রি করে ঠিকই ফায়দা লুটে নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। শহরে সবজি কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে ক্রেতাদের। তবে শহরের সবজি বিক্রেতারা বলছেন, তারাও খুব বেশি লাভ করেন না।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি রবি মৌসুমে রাজশাহীতে সবজি চাষের লক্ষমাত্রা ধরা আছে ১২ হাজার হেক্টর জমি। এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে সাত হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। চাষিরা বলছেন, এবার সবজির দাম চড়া থাকলেও তারা ভালো দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
তবে চার চিটারের মোড়ে আলফাজ শেখ নামে এক পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী বলেছেন, বাজারে নিয়ে বিক্রির আগেই অনেক সবজি নষ্ট হয়। বহন খরচও আছে। এজন্য চাষিদের সবজির দাম দেয়া হয় কিছুটা কম।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি কাজী গিয়াস বলেন, কৃষকের উৎপাদিত সবজিতে মধ্যস্বত্ত্বভোগিদের যে দৌরাত্ম্য, তাতে কৃষক এবং সাধারণ ক্রেতা- উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই শুধু শহরেই নয়, কৃষকের ক্ষেত থেকে শুরু করে গ্রামের পাইকারি বাজারগুলোতেও জোরদার করতে হবে প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থা।
জানতে চাইলে জেলা বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা শামিমূল হক বলেন, তারা বাজার থেকে পণ্যের মূল্য সংগ্রহ করেন। শহরের সবজি দোকানগুলোতেও মূল্য তালিকা টাঙানোর নির্দেশ দিয়ে আসেন। তবে জনবলের অভাবে গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে সব সময় যাওয়া হয় না। এই সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগিরা সবজির দাম নিয়ে চাষিদের ঠকিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা যেন চাষিদের ঠকাতে না পারেন, সেজন্য তিনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
দৈনিক দেশজনতা /এমএইচ